মা মনসা হিন্দুধর্মের লৌকিক সর্পদেবী। মধ্যযুগের লোককাহিনীবিষয়ক মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান চরিত্র। সর্পদেবী হিসেবে মনসার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অথর্ববেদে। পুরাণে তাঁকে ঋষি কাশ্যপ ও নাগ-জননী কদ্রুর কন্যা বলা হয়েছে। খ্রিস্টীয় ১৪শ শতাব্দী নাগাদ মনসা প্রজনন ও বিবাহের দেবী হিসেবে চিহ্নিত হন এবং শিবের আত্মীয় হিসেবে শৈব দেবমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত হন। কিংবদন্তি অনুযায়ী, শিব বিষপান করলে মনসা তাঁকে রক্ষা করেন সেই থেকে তিনি বিষহরি নামে পরিচিতা হন। তাঁর জনপ্রিয়তা দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত প্রসারিত হয়।
মনসার পূজকেরা শৈবধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেও অবতীর্ণ হন। শিবের কন্যারূপে মনসার জন্মকাহিনি এরই ফলস্রুতি। এর পরেই হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদী মূলধারায় মনসা দেবীরূপে স্বীকৃতিলাভ করেন। ভক্তদের কাছে মা মনসা বিষহরি (বিষনাশকারিণী), জগৎগৌরী, নিত্যা (চিরন্তনী) ও পদ্মাবতী নামেও পরিচিতা। তাঁর পূজা প্রধানত বাংলা ও উত্তর ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত। বর্ষার প্রকোপে এ সময় সাপের বিচরণ বেড়ে যায়, তাই সর্পদংশন প্রতিরোধ ও সাপের বিষের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে তাঁর পূজা করা হয়। এছাড়া ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্তুতির জন্য মা মনসার পূজা করা হয়।
মনসা মূলত একজন আদিবাসী দেবী। নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে তাঁর পূজা প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুসমাজেও মনসা পূজা প্রচলন লাভ করে। বর্তমানে মনসা আর আদিবাসী দেবী নন, বরং তিনি একজন হিন্দু দেবীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। হিন্দু দেবী হিসেবে তাঁকে নাগ বা সর্পজাতির পিতা কশ্যপ ও মাতা কদ্রুর সন্তান রূপে কল্পনা করা হয়েছে।
মা মনসার মূর্তিতত্ত্ব
মনসা সর্বাঙ্গে সর্পাভরণভূষিতা এবং পদ্ম অথবা নাগপৃষ্ঠে আসীনা। তাঁর মাথার উপর সপ্তফণাযুক্ত নাগছত্র দেখা যায়। কখনো কখনো তাঁর কোলে একটি শিশুকেও দেখা যায়। মনে করা হয় এটি তাঁর পুত্র আস্তিক। মনসাকে “একচক্ষু কানা” (চাঁদ সদাগরের বিখ্যাত উক্তি অনুযায়ী, “চেঙমুড়ী কানী”) দেবীও বলা হয়। কারণ তাঁর একটি চোখ সৎ-মা চণ্ডী কর্তৃক দগ্ধ হয়েছিল।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে, প্রতিমায় মনসা পূজা করা হয় না। মনসা পূজিতা হন স্নুহী বা সীজ বৃক্ষের ডালে অথবা বিশেষভাবে সর্পচিত্রিত ঘট বা ঝাঁপিতে। যদিও কোথাও কোথাও মনসা মূর্তিরও পূজা হয়। বাংলায় মনসা পূজা বহুল প্রচলিত। এই অঞ্চলে মনসার মন্দিরও দেখা যায়। বর্ষাকালে সাপেদের প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে বলে এই সময়ই মনসা পূজা প্রচলিত। শ্রাবণ মাসে নাগপঞ্চমীতেও মনসার পূজা করা হয়।
এই হল মনসা-মঙ্গল কাব্যের কাহিনীর সার। এরমধ্যে নানা কবির লেখনীতে কিছু কিছু পার্থক্য আছে। তবে মূল কাহিনীর খুবই কম জায়গাতেই এই পার্থক্য।