বেদ এবং গীতার মধ্যে হিন্দু ধর্মের গ্রন্থ কোনটা? 🕉🔱🕉

🕉🔱🕉জয়দীপ মহারাজ🕉🔱🕉

প্রথমেই জানবে “হিন্দু” ধর্ম বলে কোন ধর্ম নেই। ইদানীং “হিন্দুধর্ম” শব্দটির বহুল ব্যবহার এবং তাই নিয়ে এত বেশি চর্চা চলছে যে এই কথা শুনে একটু ধাক্কা খেতে পারো কিন্তু তাও জেনে রেখো যে “হিন্দু” বলে কোন ধর্ম নেই। বেদ, উপনিষদ, ভগবত গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ও শঙ্করাচার্য থেকে শুরু করে আধুনিক কালের চৈতন্যদেব পর্যন্ত “হিন্দু” শব্দটি তুমি কোথাও পাবে না। আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে ইউরোপীয়ানরা — বিশেষত জার্মানরা প্রথম ‘হিন্দু’ শব্দটি ব্যবহার করে। আলেকজাণ্ডারের সৈন্যরা গ্রীস থেকে সিন্ধু নদ অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করে। ওরা ‘স’ উচ্চারণ করতে পারত না, তার পরিবর্তে ‘হ’ উচ্চারণ করত। ফলে ‘সিন্ধু’ শব্দের বদলে ওরা বলল ‘হিন্দু’। এই উপমহাদেশের যা কিছু ওরা বুঝতে পারেনি সবকিছুকেই হিন্দু, হিন্দি, হিন্দ্, হিন্দুস্থান — এই সকল নাম দিল।

ভারতবর্ষে কোন নির্দিষ্ট ধর্ম নেই, হাজার হাজার ধর্মের উপাসনাস্থল এই ভূমি। যেমন তুমি যদি কালীকে পছন্দ করো তাহলে তোমার শাক্ত-ধর্ম, যদি শিবকে পছন্দ করো তাহলে শৈব-ধর্ম, গণেশকে পছন্দ করলে গাণপত্য-ধর্ম, যদি তুমি সূর্যকে প্রধান দেবতা বলে মনে করো তাহলে তুমি সৌর্য-ধর্ম, বা তুমি যদি এসবের কোনটাই না মেনে নিজের গুরুকেই শেষ কথা বলে মনে কর তাহলে তুমি গুরুবাদী, তুমি যদি ঈশ্বরের কোন রূপ মানতে না চাও তাহলে তুমি নিরাকারবাদী। এছাড়াও জ্ঞেয়বাদী, অজ্ঞেয়বাদী, সাকারবাদী, নিরাকারবাদী, ব্রহ্মবাদী, ঈশ্বরবাদী এইরকম বিভিন্ন ধর্মমত রয়েছে। আবার কারুর হয়ত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি আনুগত্য বেশি, তো কেউ বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণকে বিশেষ পছন্দ করে, কেউ হয়ত গোপাল ভাবে কৃষ্ণকে দেখতে চায়, অন্যজন হয়ত রথের উপর গীতার প্রবচনরত শ্রীকৃষ্ণকে বেশি মানে। সুতরাং এইভাবে ভিন্ন ভিন্ন ভাব অনুযায়ী অগুনতি ধর্মমত রয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে এই ভিন্ন ভিন্ন উপাসনা পদ্ধতিকে বিশেষ কোন নামও দেওয়া হয়নি। এককথায় এই সব কিছুকে বলা যেতে পারে সনাতন ধর্ম। এবার প্রশ্ন, কখন সনাতন বলা হয়? — যতক্ষণ মানুষের চলা সত্যের পথে ততক্ষণ সেটা সনাতন, আর সেই চলা যদি পরাধীনতার দিকে বা মিথ্যার দিকে হয় তখন আর সেটা সনাতন নয়, ওটা তখন সম্প্রদায়। এবার তোমার এই সত্যের পথ অপরের সাথে সবসময় নাও মিলতে পারে, তাতেও কোন বিরোধ নেই। তুমি হয়ত কবির বা রামপ্রসাদের মত গান করতে পছন্দ করো — তুমি ভাবলে গান তোমার সাধনা, গানের মধ্যে দিয়ে তুমি তোমার ঈশ্বরকে পাবে — তাহলে তোমার কাছে সেটাই সনাতন। ভারতবর্ষ তোমার ধর্মকেও গ্রহণ করবে। অর্থাৎ যতক্ষণ তুমি সত্যের পথে আছ, যতক্ষণ তুমি sincerely নিজের পথে এগোচ্ছ, যতক্ষণ তোমার ধর্ম অপর কাউকে বিরক্ত করছে না ততক্ষণ সেটা সনাতন ধর্ম। ‘নিজে বাঁচ এবং অপরকে বাঁচতে সাহায্য করো’ — এই চলার নাম ধর্ম।

সুতরাং বুঝতে পারছ হিন্দু-ধর্ম বলে কোন ধর্ম নেই, এটা বিদেশীরা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। আমাদের ধর্ম সনাতন ধর্ম। বহু মত, বহু পথ, অনন্ত পরিধান, তাই প্রতি নিয়ত নতুন নতুন ধর্ম তৈরি হচ্ছে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ এলেন, তাঁকে নিয়ে এক আরেক ধর্ম শুরু হলো। রামকৃষ্ণ মিশন তৈরি হলো, যে রামকৃষ্ণ মিশন এক সময় বলেছিল যে আমরা হিন্দু ধর্ম নই, আমরা রামকৃষ্ণ ধর্ম। এইরকম কথা ভারতবর্ষেই বলা যায়, পৃথিবীর অন্যান্য কোন দেশ এই বৈচিত্র্যকে স্বীকার করবে না।

আবার দ্যাখো, খ্রিস্টান ধর্ম, মুসলিম ধর্ম, ইহুদি ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে একটা প্রধান গ্রন্থ থাকে, একজন Prophet বা অবতার থাকেন, একটা প্রধান মন্দির থাকে, প্রধান symbol থাকে তার। এই সব কিছুর উপর base করে ধর্মগুলো দাঁড়িয়ে আছে। যেমন খ্রিস্টান ধর্মের একমাত্র পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেল, ওদের অবতার যীশু, ওদের symbol ক্রস, মূল প্রতিষ্ঠান ভ্যাটিকান সিটি বা খ্রিশ্চান ক্যাথলিক চার্চ। ভারতবর্ষে কিন্তু এইরকম কোন নির্দিষ্ট একটা গ্রন্থের নাম, দেবতার নাম বা মহাপুরুষের নাম বলতে পারবে না।

বেদ, উপনিষদ, ভগবত গীতা থেকে শুরু করে যত শ্রুতি রয়েছে, দক্ষিণ-ভারত উত্তর-ভারত এবং পূর্ব-ভারত মিলিয়ে যত হাজার হাজার শাস্ত্র রয়েছে এবং যত মহাপুরুষেরা এসেছেন, তাদের নিয়ে যে সকল নতুন নতুন শাস্ত্র রচনা হয়েছে ও আজও হয়ে চলেছে সবটাই এই দেশের অমূল্য সম্পদ। এত রকম বৈচিত্র থাকা সত্তেও এখানে কোনো রকম অসুবিধা হচ্ছে না বা মারামারি-কাটাকাটি হচ্ছে না। সুতরাং ভারতবর্ষের একটা ধর্মও সেমেটিক ধর্মগুলোর চরিত্রের সাথে মেলে না। তাই বলছি হিন্দু ধর্ম বলে কোন পৃথক ধর্মের অস্তিত্ব নেই, ভারতবর্ষ সনাতন ধর্মের দেশ।

এবং এই সনাতন পরম্পরার মধ্যে প্রাচীনকালের মুনি, ঋষি, অবতার থেকে শুরু করে বিবেকানন্দ, অরবিন্দের মত সকল মহাপুরুষরাই রয়েছেন। এমনকি ভারতবর্ষের ধর্ম যীশুকেও একজন অবতার বলে মানে বা প্রফেট মহম্মদকেও একজন অনন্য সাধারণ সংস্কারকরূপে সম্মান দেয়, ইজরায়েলের মুসাকেও ভারতবর্ষ প্রত্যাখ্যান করে না। এটাই ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট্য — যে যেখানে যা করছে তাকে এই দেশ মান্যতা দেয়। সুতরাং আবারও বলছি হিন্দু-ধর্মের কোন অস্তিত্ত্ব নেই। তাই হিন্দু ধর্মের কোন নির্দিষ্ট গ্রন্থের নাম বলার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

আমাদের চারটে বেদ আছে, উপনিষদ আছে, ভগবত গীতা আছে, এগুলো প্রামাণ্য। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে বেদ উপনিষদ লেখা হয়েছে কিন্তু তার অনেক আগে থেকে এগুলো ছিল, আধুনিক রিসার্চে দেখা যাচ্ছে অন্তত তিরিশ হাজার বছর ধরে শ্রুতি পরম্পরায় এগুলো সংরক্ষিত ছিল। তখনও লিপি আসেনি, তাই মানুষ কাব্যিক ছন্দে এই জ্ঞানকে মুখস্থ করে রাখত। গুরু বলতেন এবং শিষ্যরা সেই কথা মুখস্থ করে নিতেন। তাই দেখবে বেদ, উপনিষদ ও গীতা কাব্যের ছন্দে লেখা হয়েছে, কারণ কাব্যের ছন্দে মুখস্থ করতে সুবিধা হয়। যেমন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের যখন আমরা কিছু মুখস্থ করাই তাদের ছড়া বলে বলে মুখস্থ করাই কারণ ওভাবে সুর করে পড়লে খুব দ্রুত ভালো ভাবে সবকিছু মনে থেকে যায়। তাই লেখার ভাষা আসার আগে গুরু-শিষ্য পরম্পরাতে বেদ উপনিষদ রামায়ণ মহাভারত ও গীতাকে শ্রুতির আকারে ধরে রাখা হয়েছিল। লিপি আবিষ্কারের পর ব্যাসদেব এই সবকিছুকে সংকলন করলেন এবং দেবনাগরী ভাষায় সেগুলো লেখা হলো। তাই বেদকে বলা হয় ‘উদগীত প্রাণবিদ্যা’ অর্থাৎ সেটা কারুর লেখা নয়। ধ্যানের গভীরে ঋষিরা সেই সনাতন সত্য বোধ করেছেন এবং সেই জ্ঞানকে প্রকাশ করেছেন। জ্ঞানকে তাঁরা আবিষ্কার করলেন বললে ভূল হবে। যেমন ধরো আমি যদি আজ তোমাদের বলি প্রত্যেক মানুষের শরীরে একটা হার্ট আছে, তার মানে এই নয় সেটা আমি বলার আগে ছিল না। আমি শুধু সেটাকে নাম দিয়ে তোমাদের কাছে প্রকাশ করলাম এবং তুমি সেটা জানলে। আরেকজন হয়ত বলল তার ভাষায় ওকে ‘হৃদয়’ বলে, তৃতীয় একজন হয়ত বলল তার ভাষায় একে ‘দিল’ বলে। এখানেও তাই। বেদের জ্ঞান সনাতন। মানুষ যত অন্তর্মুখী হয়েছে সেই জ্ঞান তার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। তাই বেদের প্রবর্তক হয় কিন্তু রচয়িতা হয় না। আরও একটা উদাহরণ দিলে তোমার বুঝতে সুবিধা হবে। ধরো তুমি গাছের নিচে বসে আছ, তোমার নাম আইজ্যাক নিউটন। এবার গাছ থেকে যেই একটা আপেল মাটিতে পড়ল তুমি ভাবতে শুরু করলে আপেলটা কেন আকাশে উড়ে গেল না, কেন মাটিতে পড়লো? বাড়িতে গিয়ে অঙ্ক কষে তুমি গ্র্যাভিটি আবিষ্কার করলে। এবার বলো তুমি প্রথম মাধ্যাকর্ষণ বা Gravity উচ্চারণ করলে বলেই কি মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রথম কার্যকরী হোলো? তা তো নয়। যবে থেকে পৃথিবী আছে, মাধ্যাকর্ষণও আছে। তুমি সেটাকে প্রথম ফর্মুলার আকারে আনলে, সেই জ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক ভাষ্য দিলে।

তেমনই বেদ কারুর মস্তিষ্ক উদ্ভূত নয় অর্থাৎ মাথা খাটিয়ে ভেবে বার করা কিছু তাত্ত্বিক আলোচনা নয়। বেদের জ্ঞান শাশ্বত, সনাতন। জীবনের সত্য কি, আত্মার স্বরূপ কি — এই সনাতন জ্ঞানই বেদ। তুমিও যদি এখন ধ্যানের গভীরে প্রবেশ করো তোমার মধ্যেও এই জ্ঞান প্রকাশিত হবে। তোমাকে আর কষ্ট করে বেদ পড়তেও হবে না, তোমার মধ্যে থেকেই বেদ উচ্চারিত হবে। তাই বেদ হিন্দুরও নয়, খ্রীশ্চানেরও নয় বা মুসলমানেরও নয়, বেদ সর্বকালে সকলের জন্য। বেদ মরুভূমির মানুষদেরও, বেদ পাশ্চাত্যবাসীদেরও, বেদ ভারতীয়দেরও। দক্ষিণ উত্তর বাঙালি হিন্দিভাষী — বেদ সর্বজনীন এবং সর্বকালীন।

{স্থান — জিয়াগঞ্জ, বর্ণালী পার্ক,

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন