
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। তাই ঋতু পরিক্রমায় হেমন্ত আসে শীতের আগেই। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে হেমন্ত ঋতু। এখন চলছে মাঠে মাঠে সোনালি ধানের সমারোহ, বাতাসে দোল খাচ্ছে কিষান-কিষানির স্বপ্ন। কার্তিকের শেষদিকে ও অগ্রহায়ণের শুরুতেই শুরু হয়েছে আমন সোনালি ধান কাটা, আবার কেউবা ঘরে তুলছেন আগাম ধান। তবে গ্রামবাংলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালি জাতির হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্য ও সবচেয়ে প্রাচীনতম উৎসব নবান্ন।
অগ্র শব্দের অর্থ আগে হায়ন শব্দের অর্থ বছর। বছরের আগে বা শুরুতে ছিল বলেই এ মাসের নাম অগ্রহায়ণ। অগ্রহায়ণে নবান্ন নিয়ে আসে কিষান-কিষানির মনে খুশির বার্তা। আনন্দ বার্তা পৌঁছানোর আগে তাদের শরীরে লেগে থাকে রক্তঝরা ঘাম। তারা শ্রমে-ঘামে মাঠে ফসল ফলান বলেই আমরা নতুন করে অন্ন খেয়ে বাঁচতে পারি। কিষান-কিষানিরা দীর্ঘদিন অক্লান্ত পরিশ্রমে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে এক বুক উচ্ছ্বাস নিয়ে ঘরে তোলেন নতুন ফসল। তাদের উদ্দেশ্য দেশ ও দশের কল্যাণ সাধন করা। শ্রম, সাধনা আর ত্যাগ-তিতিক্ষার মহান আদর্শকে ধারণ করে সবার ঊর্ধ্বে তাদের অবস্থান। তাই তাদের চেয়ে বড় সাধক আর কেউ হয় না।
প্রান্তিক কিষান-কিষানিদের সব হাসি-কান্নার অবসান ঘটিয়ে অগ্রহায়ণের নতুন আমন ধান ঘরে উঠানোর কাজের মাঝে খুঁজে পায় অপার আনন্দ। গ্রাম বাংলার নতুন এক আবহের সৃষ্টি হয়। নবান্ন উৎসব যেন সব দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালিদের হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি। প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মবর্ণনির্বিশেষে নবান্নকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতি উৎসবে মেতে ওঠে। একে অন্যের মধ্যে তৈরি হয় সামাজিক সুসম্পর্ক, সম্প্রীতি আর ভালোবাসা। এ উৎসবকে ঘিরে সনাতনী সম্প্রদায়ের আছে নানা রকম লৌকিক পার্বণ বিধি। নব + অন্ন= নবান্ন। নতুন অন্ন নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী জলে-স্থলে ও কাককে পিতৃপুরুষের বিগত-আত্মার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা নবান্নের একটি বিশেষ লৌকিক প্রথা। এভাবেই অতীতে নবান্নে সোনালি ধান কাটার উৎসবে মুখরিত হতো গ্রামের প্রতিটি আঙিনা। মুসলিমরা নতুন ধান কেটে বউ-ঝি, মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে আনতেন। তাদের নিয়েই চলত পিঠা উৎসব। নতুন চাল ঢেঁকি দিয়ে গুঁড়া করে তৈরি করা হতো হরেক রকম পিঠা: ভাপা, চিতই, দুধপুলি, পিঠাপুলি, পায়েস, সেমাই, ক্ষীর, খই, মুড়ি আরও কত কী! শীতের আগমনিতে খেজুর গাছের রস দিয়ে তৈরি হতো এসব সুস্বাদু পিঠা। এ নবান্নকে নিয়ে অনেক কবি, সাহিত্যিক লিখে গেছেন বহু কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস। নবান্নে হলুদ পাকা ফসলি মাঠ, শীতের আগমনি, অতিথি পাখির সমাগম, ধানখেতের হরেক রকম পাখি দেখা মিলে। তাই তো কবি জীবনানন্দ দাস নবান্ন উৎসবকে নিয়ে বলেছেন-‘আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এ বাংলায়। হয়তো মানুষ নয় হয়তোবা শঙ্খ চিল, শালিকের বেশে, হয়তো ভোরের কাক হয়ে এ কার্তিকের নবান্নের দেশে’।
সোনার বাংলায় নবান্ন উপলক্ষ্যে গ্রাম-গঞ্জে, নগরে-নগরে বাড়ির আঙিনায় স্কুলের মাঠে অনুষ্ঠিত হতো যাত্রা, নাটক, জারি-সারি, নাচ-গানের আসর। কোথাও কোথাও গ্রাম্য মেলার দেখাও মিলত। প্রতিবছর পহেলা অগ্রহায়ণ রাজধানীর রমনার বটমূলে নবান্নোৎসব হয়ে আসছে। এ উৎসবকে ঘিরে সেখানে গ্রামীণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এছাড়া বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নবান্নে পিঠা উৎসবের আয়োজন করে থাকে। ইদানীং জেলা ও উপজেলা প্রশাসন আয়োজন করছে নবান্নের পিঠা উৎসব। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে সবকিছুর। বাংলার হাজার বছরের এ সংস্কৃতি যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। আগের মতো এখন আর উৎসবমুখর দেখা যায় না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘরে ঘরে হরেক রকম পিঠা তৈরির দেখা মিলে না। বাড়িতে বাড়িতে পিঠার ঘ্রাণও পাওয়া যায় না। বাড়ি বাড়ি আত্মীয়দের সমাগমও খুব বেশি চোখে পড়ে না। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ইচ্ছাশক্তি, শখ, আনন্দ-ফুর্তি সবই যেন হ্রাস পাচ্ছে। খোলা মাঠ দিনের পর দিন পড়ে থাকলেও কেউ খেলতে যায় না। আগামী প্রজন্মের কাছে গ্রামীণ জনজীবনের এসব চিত্র একদিন হয়তো শুধুই স্মৃতি হয়ে থাকবে।