মহাকালের বন্দী

আদিত্য কুণ্ডু

১)

বিশ্রী একটা ভোঁতা শব্দের সাথে উল্টোদিকের দেওয়ালের গায়ে ছিটকে গেল খানিক তাজা রক্তের ধারা। থেঁতলানো মাথা নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া শরীরটা ঘরের মেঝে স্পর্শ করতেই দু ফুট লম্বা লোহার পাইপটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল অ্যাডাম স্লেড। নিথর কারারক্ষীর কোমরে গোঁজা রিভলবারটা এক হাতে নিয়ে ভয়ে বোবা হয়ে যাওয়া মারিয়া লরেন্সের সঙ্গে জেলের বাইরে পা রাখলো অ্যাডাম স্লেড। ‘ইন্টারপ্লানেটারি ভিডিও’র পক্ষ থেকে আসা বাইশ বছরের তরুণী সংবাদিকটি খুবই উৎসাহে ছিল অ্যাডাম স্লেডের ফাঁসির আগের শেষ সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য, কিন্তু পরিস্থিতি যে এরকম হয়ে উঠবে তা কি সে দুঃস্বপ্নেও ভেবেছিল? লোহার পাইপটা স্লেড কোথা থেকে জোগাড় করেছিল কেউ জানে না, কিন্তু গারদের মধ্যে রক্ষীর সাথে একটি যুবতীকে ঢুকতে দেখেই ছকটা কষে ফেলেছিল সে। তাই অন্যান্য বন্দীরা তাদের ঘরগুলোর ভিতর থেকে আশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে গরাদের গায়ে টিনের কাপ ছুঁড়ে মারলেও, অ্যাডাম স্লেড এখন বাইরে।

 

“আপনার খুব ভয় করছে, তাই না?”, জিজ্ঞেস করল স্লেড। তার দশাসই চেহারার মাংসপেশিগুলোতে যে শক্তির কোন অভাব নেই সেটা তার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এক জোড়া ঢুলু ঢুলু চোখ আর থুতনির কাছে অল্প দাড়ি লোকটার হিংস্রতাকে যেন আরো খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রশ্নটার সরাসরি উত্তর না দিয়ে মারিয়া লরেন্স বলল, “আপনি তো কোনো কিছুতেই ভয় পান না।” বিগত পাঁচ ঘন্টা ধরে অমানুষিক পরিশ্রম করে এখন সে আর স্লেড দাঁড়িয়ে আছে ওই বিশাল গম্বুজের বাইরে। একটার পর একটা সিঁড়ি  দিয়ে উঠে গম্বুজের মাথায় পৌঁছে তারপর জলের ট্যাংকের পাইপটা ধরে আবার গম্বুজের পিছন দিকে নামতে হল বলেই কিনা সে জানেনা, কিন্তু প্রাথমিক ভয়টা মারিয়া এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। তাছাড়া সে একজন সাংবাদিক, আর এখানে সে এসেছে একটা সেনসেশনাল স্টোরির জন্য। তাই ঘাবড়ালে চলবে না।

 

“এগোতে থাকুন”, স্লেড আদেশ দিল। “আপনার বিরুদ্ধে আমার কোন রাগ বা ক্ষোভ নেই, কিন্তু যদি কোন রকম চালাকি করার চেষ্টা করেন,” কঠোর গলায় আরেকবার মনে করিয়ে দিল সে, “আপনাকে মেরে ফেলতে আমার এক সেকেন্ডও সময় লাগবে না। বুঝেছেন? আমার কিচ্ছু হারানোর নেই। ওরা আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চায়, তাই তো? বেশ, তাহলে আগে আমাকে ধরুক, আর যতক্ষণ আপনি আমার পণবন্দী হয়ে রয়েছেন, ততক্ষণ ওরা আমার গায়ের একটা লোমও ছুঁতে পারবে না। চুপচাপ থাকুন আর আমার কথা মেনে চলুন, তাহলে বেঁচে থাকবেন।”

বড় বড় পা ফেলে স্লেড এগিয়ে যাচ্ছিল, তার গতির সঙ্গে তাল মেলাতে মারিয়াকে প্রায় দৌড়াতে হচ্ছিল। “কী মনে হচ্ছে? কতক্ষণ পারবেন এভাবে?”, জিজ্ঞেস করল সে। স্লেড উত্তর দিল না। একটা কালচে রংয়ের ঢালু পাথরের উপর দাঁড়িয়ে সে চারিদিকটা দেখছিল। যতদূর চোখ যায়, শুধু নানান আকারের দৈত্যাকৃতি পাথর, অদূরেই রয়েছে সমুদ্র। আদিম সমুদ্র, যার স্বচ্ছ, লবণমুক্ত ফেনিল জল বিষধর কালনাগিনীর মতো ফণা তুলে ক্রমাগত তেড়ে এসে ছোবল মারছে পাথরের শরীরে। মাথার অনেক উপরের শূন্য আকাশ কেমন যেন ধোঁয়াটে বর্ণ ধারণ করে রয়েছে। সমুদ্রের ক্রুদ্ধ গর্জন ছাড়া সমস্ত চরাচরে কোনো স্পন্দনের আভাস নেই।

“শুধু জল”, খানিক অন্যমনস্ক ভাবেই যেন স্বগতোক্তি করল স্লেড।

“জল আছে বটে, কিন্তু কোন খাবার নেই মিস্টার স্লেড,” মুচকি হেসে বলল মারিয়া। “তবে আপনি যদি আরো কয়েক হাজার বছর ধরে আমাকে পণবন্দী বানিয়ে রেখে অপেক্ষা করতে পারেন, তাহলে হয়ত খাবারের সন্ধান পেলেও পেতে পারেন, যদিও আপনার খাবার খাওয়ার সেই দৃশ্য দেখার জন্য আমি বোধহয় তখন আর বেঁচে থাকব না।”

“তোমার কি মনে হয়, কোন কিছু না ভেবেই আমি বেরিয়ে এসেছি?”, স্পষ্ট রাগের সুর এবার স্লেডের গলায়।

“আমি কি করে জানব আপনি কিছু ভেবেছেন কিনা? যেরকম মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন..,” মারিয়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই হুংকার দিয়ে ওঠে স্লেড, “এই যে শোনো, যতক্ষণ তুমি আমার জিম্মায় আছো ততক্ষণ ওরা আমাকে ফলো করতে পারে কিন্তু হঠাৎ করে আক্রমণ করার মতন বোকামো করবে না। একটা হেলিকপ্টার হয়তো পাঠাতে পারে, কিন্তু তাতেও কোন লাভ হবে না। মরিয়া? হ্যাঁ আমি মরিয়া! আমি বেঁচে থাকার জন্য মরিয়া! ওই জেলখানার ভেতর থাকলে আমাকে ওরা ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতন টিপে মারত। এখনো ওরা অবশ্য তাই চায়, যদি আমাকে ওরা ধরতে পারে, সোজা মেরে ফেলবে। ঠিক আছে মারুক! মারুক! জীবন একটাই, মরবও একবার।”

 

 

(২)

হাঁটতে হাঁটতে দুজনে এসে পৌঁছালো একটা প্রকাণ্ড টিলার উপর। এখান থেকে নিচের দিকে তাকালে দেখা যায় সেই আদিম, অপরিণত সমুদ্র, যে সমুদ্র এখনো লবণাক্ত হয়নি। ক্ষুধার্ত বাঘের মতো অস্থির ভাবে টিলার উপরে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ থেমে গিয়ে নিচের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে স্লেড বলে উঠলো, “ওই সমুদ্রের পাড় ধরে আমরা জেলে ফিরে যাব।”

“ফিরে যাব? জেলে?”, মারিয়া যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না।

“আরে হ্যাঁ, ফিরে যাব,” বিরক্ত বলায় বলে স্লেড, “তুমি নিজেই তো বললে যে এখানে কোনো খাবার নেই। আর সত্যিই তো, প্রাণের অস্তিত্বই যেখানে নেই সেখানে খাবার থাকবে কি করে? একটা জেলখানার পক্ষে এটা একেবারে আদর্শ জায়গা। যার মাথা থেকে এই বুদ্ধিটা বেরিয়ে ছিল না, তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত। অতীতের মাটিতে তৈরি একটা জেলখানা। কি যেন বলে এটাকে?”

“আর্কেওজোয়িক”, উত্তর দেয় মারিয়া।

“আর্কেওজোয়িক, আর্কেওজোয়িক প্রিজন,” বিড়বিড় করতে থাকে স্লেড, “মনের আশ মিটিয়ে পালাও, যত খুশি পালাও, কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়? এই পৃথিবী তো একটা সদ্যজাত শিশুর মতন, কোনো প্রাণীর জন্মই হয়নি এখনো। তাই পালানোর চেষ্টা করা মানে উপোস করতে করতে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। এর সাথে তুলনা করলে তো অন্য যে কোনো হাই সিকিউরিটি জেল বাচ্চাদের পিগি ব্যাংকের মতো মনে হয়।”

“সেই জন্যই তো আজ পর্যন্ত কেউ পালাতে পারেনি এখান থেকে,” টিলা থেকে নিচের দিকে নামতে নামতে বলে মারিয়া।

“আজকের আগে কেউ কি পণবন্দি হয়েছিল?”, হাতে ধরে থাকা রিভলবারের মুখটা দিয়ে মারিয়ার পিঠে একটা খোঁচা দেয় স্লেড। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মারিয়া আচমকা জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি আমায় মেরে ফেলবেন?”

“প্রয়োজন না পড়লে শুধু শুধু মারব কেন? ওসব ফালতু কথা ছেড়ে গম্বুজের দিকে এগোতে থাকো। আমরা আবার ওটার কাছে যাব, যদিও গরাদ লাগানো খাঁচার ভেতরে আমরা ঢুকবো না, আমাদের লক্ষ্য টাইম মেশিন।”

“কিন্তু..”, কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে যায় মারিয়া।

“কোনও কিন্তু নয়। না খেয়ে শুকিয়ে মরার জন্য অ্যাডাম স্লেড জন্মায়নি,” দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে আর্কেওজোয়িক প্রিজন ভেঙ্গে পালানো এক কুখ্যাত অপরাধী।

 

সমুদ্রের পাড় ধরে হাঁটতে থাকে দুজনে। এই সমুদ্রের জল নীল নয়, ধূসর, আকাশের মতন ছাই বর্ণ। হাজার হাজার বছর আগেকার এই পৃথিবীতে পরিষ্কার নীল আকাশ কখনোই দেখা যায় না, কারণ বাতাসে বাষ্পের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি আর প্রায় সর্বক্ষণ অঝোর ধারায় বৃষ্টিপাত হয়ে চলে। আদিম পাথুরে জমি বেশিরভাগ সময়ে পিছল হয়ে থাকে।

“সাবধান!” স্লেডের এই হঠাৎ চিৎকারের কারণটা ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই এক জোড়া বলিষ্ঠ হাতের ধাক্কায় মারিয়া এসে পড়ে টিলার পাদদেশের কাছে থাকা একটা বড় পাথরের আড়ালে। একটা পরিচিত আওয়াজ কানে আসতে উপরের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারে মারিয়া। হেলিকপ্টার! একটা হেলিকপ্টার চক্রাকারে উড়তে উড়তে ক্রমশ এগিয়ে আসছে এই টিলার দিকেই! মারিয়া প্রাণপণে চাইল হেলিকপ্টার টার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। কিন্তু স্লেডের মুখের দিকে তাকিয়ে তার রক্ত জমে গেল। কিন্তু কিছু না করলে তো ওকে এই ভাবেই বন্দি হয়ে থাকতে হবে। আচ্ছা, একবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলে হয় না? গলার সমস্ত জোর একত্রিত করে একবার চেঁচিয়ে উঠলে কি হেলিকপ্টারের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ওই লোকটা দেখতে পাবে না?

কিন্তু চিৎকার করার সুযোগটুকুও পেল না মারিয়া। স্লেডের লোহার মতন হাতের একটা ঘুসি তার মুখে আছড়ে পড়ে তাকে অজ্ঞান করে দিল।

 

মারিয়ার জ্ঞান যখন ফিরল, তখন দৃষ্টিসীমার মধ্যে আর কোনো হেলিকপ্টার নেই।

“আঘাত করার জন্য দুঃখিত,” বলল স্লেড। যদিও তার মুখের দিকে তাকিয়ে দুঃখের ছায়াটুকুও দেখতে পেল না মারিয়া।

“হাঁটতে পারবে তো?”, আগের মতোই ধাতব গলায় জিজ্ঞেস করল স্লেড। ঘাড় নেড়ে উঠে দাঁড়াল মারিয়া। তার পা টলছে, মাথাটাও যেন একটু ঘুরছে, তবুও সে স্লেডের সঙ্গে এগিয়ে চললো সমুদ্রের পাড় ধরে। সে একজন সাংবাদিক, আর আজ সে এখানে এসেছিল এমন একটা  সাক্ষাৎকার নিতে যেটা হইচই ফেলে দিত চারিদিকে, সংবাদমাধ্যমের জগতে তার কেরিয়ারের অগ্রগতি আটকাত কার সাধ্য?

কিন্তু সেই সাফল্যমণ্ডিত কেরিয়ারের স্বাদ পেতে গেলে তো তাকে বেঁচে থাকতে হবে। বেঁচে কি সে থাকবে?

সময়ের কারিকুরিতে তৈরি এক অসাধারণ কারাগার, যেখান থেকে পালানো কার্যত অসম্ভব, যদি না..

যদি না কোনো বন্দী একটি যুবতীকে হোস্টেজ হিসেবে নিজের কাছে আটকে রাখে, এবং কোনোভাবে গম্বুজের বাইরের দিকে অবস্থিত টাইম মেশিনের কাছে পৌঁছাতে পারে।

বাইরের দিকে, কারণ বন্দীরা থাকে গম্বুজের ভিতরের অন্ধকার জেলখানার মধ্যে। তাদের পক্ষে ওই টাইম মেশিনের নাগাল পাওয়া একেবারেই সহজ নয়..

যতক্ষণ না অ্যাডাম স্লেডের মত তারাও বাইরে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হচ্ছে।

 

(৩)

অনেকক্ষণ থেকেই মারিয়ার মন বলছিল যে বৃষ্টি হবে। সত্যিই তাই হল, পায়ের নিচে কালো পাথুরে জমি এবার একটু একটু করে ভিজতে লাগলো আকাশ থেকে নেমে আসা বড় বড় ফোঁটায়।

“যদি বৃষ্টির জোর বাড়ে,” বলল স্লেড, ” তাহলে আমাদের আবার ওই টিলার নিচের বড় পাথরগুলোর আড়ালে যেতে হবে। এখানকার বৃষ্টি যে ঠিক কিরকম হতে পারে সে সম্বন্ধে তোমার ধারণা নেই। আমি আমার সেলের জানালা থেকে দেখেছি।”

কিন্তু টিলার পাদদেশে আর যেতে হল না ওদের, কারণ হঠাৎই অত উঁচু টিলার মাথাটা মড়মড় শব্দে ভেঙ্গে গিয়ে নিচের পাথরের নগরীতে আলোড়ন সৃষ্টি করে, তার প্রজাদের সাথে প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে একেবারে গড়াতে গড়াতে গিয়ে পড়লো অতল সমুদ্রে।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আকাশের উপরের অংশে নির্মিত কোনও স্লুইস গেট যেন অজানা কোনো আদেশে খুলে গেল, এবং তার ফলস্বরূপ শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। কঠিন পাথরের বুকের উপর সেই বৃষ্টির ফোঁটা বন্দুক থেকে ছোঁড়া বুলেটের মতো আক্রমণ হানতে লাগল। সে বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে লাগলে মনে হয় যেন কামারের হাতুড়ির ঘা পড়ছে, এমনই তার ওজন আর শক্তি।

“ওই পাথরগুলোর আড়ালে আমাদের যেতেই হবে,” চিৎকার করে বলল মারিয়া। চিৎকার করা ছাড়া উপায় নেই, প্রচন্ড বৃষ্টিপাতের শব্দের সাথে সাথে যেভাবে আশেপাশের প্রায় সমস্ত পাথর ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে তাতে সমস্ত জায়গাটা একটা বিভীষিকাময় যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছে।

“পাথরের আড়ালে!”, আবার চেঁচিয়ে বললো মারিয়া।

কিন্তু স্লেড কোনও কথা শুনতে রাজি নয়। মারিয়ার ডান হাতের কব্জিটা চেপে ধরে গোঁয়ারের মত এগিয়ে যাচ্ছে সে। ওই টাইম মেশিন তার চাই। হয় ওই মেশিনের কাছে সে পৌঁছবে, নয় নিজের পাগলামির জন্য মৃত্যুবরণ করবে।

ধীর পদক্ষেপে এগোতে লাগল দুজনে। স্লেড যদি কোনোভাবে একবার পা হড়কে পড়ে, তাহলে তার হাতের মুঠো থেকে রিভলবারটা ছিটকে যেতে পারে। মারিয়া শান্তভাবে অপেক্ষা করতে লাগল সেরকম একটা মুহূর্তের জন্য।

কিন্তু ভাগ্য বোধহয় আজ মারিয়ার প্রতি সত্যিই বিরূপ। কয়েক পা এগোনোর পরই একটা পাথরের খাঁজে পা আটকে মুখ থুবড়ে পড়ল সে। স্লেড একটা বিশ্রী গালাগাল দিয়ে তৎক্ষণাৎ হেচঁকা টানে তাকে তুলে দাঁড় করালো। কিন্তু মারিয়া যেন কিছুই অনুভব করতে পারল না; অসহ্য ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে, জলে ভিজে শীত করছে, তুমুল বৃষ্টিপাতের শব্দে কানে তালা ধরে যাচ্ছে। তবুও যে কি করে সে এগিয়ে চলল স্লেডের সঙ্গে, তা হয়তো সে নিজেও জানে না।

এই ভাবেই যে কখন রাত নেমেছে সেটাও মারিয়া বুঝতে পারেনি। চারপাশের অন্ধকার আর ধীরে ধীরে গাঢ় হতে থাকা কুয়াশার চাদর ভেদ করে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মারিয়ার মনে হল, এই ঘন কুয়াশার মধ্যেই তো স্লেডের কবল থেকে পালানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবলো, পালিয়ে লাভ কী হবে? স্লেডের সঙ্গে যতক্ষণ রয়েছে, সে অন্তত বেঁচে রয়েছে। একা কি সে যুঝতে পারবে হাজার হাজার বছর আগেকার এই অচেনা পৃথিবীর সঙ্গে?

 

ভোরের প্রথম আলো ফোটার সাথে ওদের নজরে এলো আরেকটা হেলিকপ্টার। মারিয়াকে নিয়ে স্লেড ক্ষিপ্রগতিতে লুকিয়ে পড়ল ভাঙা পাথরের স্তুপের মধ্যে। কিন্তু এই হেলিকপ্টারটা ওদের দিকে এলো না, কয়েকশো ফুট উপর দিয়ে উড়ে যেতে লাগল গম্বুজের দিকে। ওটা তাদের খোঁজে আসেনি।

কিন্তু হঠাৎ আগের দিনের মতোই শুরু হলো প্রচন্ড বৃষ্টি, আর তার ফলেই এগোতে না পেরে জলে ভিজে জড়সড় হয়ে যাওয়া একটা পাখির মতন  নেমে এল হেলিকপ্টারটা। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা তার ধাতব দেহের উপর আছড়ে পড়ে ছিটকে যেতে লাগল এদিক-ওদিক।

 

(৪)

ওদের থেকে ঠিক দেড়শো ইয়ার্ড দূরে দাঁড়িয়ে আছে হেলিকপ্টারটা। ভোরের আলো এখনো অতটা পরিষ্কার নয়, তাই হেলিকপ্টার থেকে বাইরে বেরিয়ে আসা তিনটে লোককে মারিয়া আবছা ভাবে দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ চারিদিক আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে কান ফাটানো শব্দে বাজ পড়ল, এবং সেই বাজের প্রকোপে উপরের দিকে ছিটকে যাওয়া ভাঙ্গা পাথরের টুকরো আবার মাটিতে এসে পড়ার আগেই নিজের ফুসফুস ভর্তি করে বাতাস টেনে নিয়ে প্রাণপণে দৌড়ালো মারিয়া।

দৌড়াতে দৌড়াতে সে চিৎকার করতে লাগলো, “হেল্প! আমাকে বাঁচান!”, তার গলার শিরা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হল, কিন্তু তবুও লোকগুলো শুনতে পেল না, কারণ তুমুল বৃষ্টি আর বজ্রপাতের শব্দে তার কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে গেল। প্রতিমুহূর্তেই তার মনে হচ্ছিল যে এখনি স্লেডের রিভলবার থেকে ছুটে আসা গুলি তার সব দৌড় চিরকালের জন্য থামিয়ে দেবে।

কিন্তু স্লেড সেরকম কোনো চেষ্টাই করলো না; মারিয়াকে মেরে ফেললে তো এই কারাগার থেকে বেরোনোর চাবিকাঠি তার হাতছাড়া হয়ে যাবে। ঘাড় ঘুরিয়ে মারিয়া দেখতে পেল, একটা করাল ছায়া চিতাবাঘের মত ক্ষিপ্রগতিতে ধেয়ে আসছে তার দিকে! মারিয়া তার ছোটার গতি বাড়ালো, কিন্তু তার নিজের পা জোড়াই যেন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্লেডের দলে যোগ দিয়েছে। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সে এবং জাহাজ ডুবি হওয়া নাবিকের খড়কুটো ধরার মতন নিজের দুই হাত তুলে হেলিকপ্টারের লোকগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করার একটা মরিয়া চেষ্টা করল, কিন্তু ততক্ষণে স্লেডের হাতের দশটা আঙুল সাঁড়াশির মত চেপে বসেছে তার গলায়।

ঠিক তখনই আবার একবার বজ্রপাত হল।

স্লেডের মুহূর্তের বিহ্বলতার সুযোগ নিয়ে মারিয়া আবার দৌড় লাগালো। পাথরের খোঁচায় তার হাত মুখ ছড়ে গিয়েছে, কপালের এক পাশ থেকে গড়িয়ে নামছে রক্তের ধারা, কিন্তু সেসব দিকে তাকানোর সময় এখন নয়। পালাতে হবে, যেভাবেই হোক পালাতে হবে।

কিন্তু এটা কোন দিকে যাচ্ছে মারিয়া? সামনে তো হেলিকপ্টার নেই, সেটা যে পিছনে পড়ে রইল! কিন্তু এখন আর ফেরার উপায় নেই, ফিরতে গেলে সোজা স্লেডের খপ্পরে গিয়ে পড়তে হবে। মারিয়া তাই দৌড়ে গিয়ে লাফিয়ে পড়লো সমুদ্রে। জল অদ্ভুত রকম শান্ত, যেন ভীষণ ধৈর্যের সাথে কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করছে।

তার পিছন পিছন স্লেডও এসে পড়ল সমুদ্রের জলে।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই তৃতীয়বার বাজ পড়লো। একটা বিরাট ঢেউয়ের ধাক্কায় মারিয়া ভেসে গেল বেশ খানিকটা দূরে, আর তারপরেই, বাতাসে ওজোনের সাথে একটা নতুন গন্ধ পেল সে। পোড়া মাংসের গন্ধ।

এতক্ষণে স্লেডকে আবার দেখতে পেল মারিয়া।  আর্কিয়োজোয়িক প্রিজন ভেঙে পালানো হিংস্র কয়েদি এখন পড়ে আছে জলের মধ্যে, সম্পূর্ণ স্পন্দনহীন।

 

হেলিকপ্টারের লোক তিনটি শেষবার বাজ পড়ার সময়ে জলের মধ্যে দুজন মানুষকে দেখতে পেয়েছিল। তাদের মধ্যেই একজন চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ম্যাডাম আপনি ঠিক আছেন?”

“হ্যাঁ আছি। স্লেড?”

স্লেডের উল্টো হয়ে পড়ে থাকা শরীরটা পাড়ের কাছে টেনে এনে সোজা করা হলো। “মারা গেছে”, বলল একজন।

“মারা গেছে!”, কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করেই মারিয়া আবার জ্ঞান হারালো, কিন্তু সে মাটিতে পড়ার আগেই লোকগুলো তাকে ধরে নিল, এবং তাকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল হেলিকপ্টারের মধ্যে।

 

বৃষ্টি থামার পর, আকাশের রঙ যখন আবার ঘন কালো থেকে পাল্টে যাচ্ছে ধূসর বর্ণে, তখন লোকগুলোর সাথে মারিয়াও আবার ফিরে এলো স্লেডের দেহটা নিয়ে যাওয়ার জন্য।

কিন্তু স্লেডের মৃতদেহটা সেখানে ছিল না!

“আপনারা যে বললেন ও মারা গেছে?”, স্তম্ভিত হয়ে প্রশ্ন করে মারিয়া।

“মরা মানুষ নিজের থেকে কোথাও যেতে পারে না ম্যাডাম,” হেসে বলে একজন, “বৃষ্টির জল আর ঢেউয়ের ধাক্কায় আবার সমূদ্রেই গিয়ে পড়েছে লাশটা।”

কয়েক মুহূর্তের জন্য সেই আদিম, অপরিণত সমুদ্রের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল ওরা সবাই। হঠাৎ পাগলের মতো হেসে উঠলো মারিয়া।

তার মানসচক্ষে তখন ভেসে উঠেছে স্লেডের মৃতদেহটা, যার থেকে লক্ষ লক্ষ পাপের জীবাণু বেরিয়ে মিশে যাচ্ছে সমুদ্রের জলে। হাজার হাজার বছর আগেকার পার্থিব সমুদ্র চেটেপুটে উপভোগ করছে এক পাপীর রক্তের স্বাদ।

স্লেড অন্যায় করেছিল, তাই শাস্তি হিসেবে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন মানবজাতির জন্মই হয়নি।

স্লেড, যার প্রথম নাম ছিল অ্যাডাম।

 

 

(মূল রচনা :- ‘Prison of a Billion Years’ – Milton Lesser)

(ভাষান্তর :- আদিত্য কুণ্ডু)

 

 

 

 

 

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন