শতবর্ষের সাক্ষী চট্টগ্রামের জে এম সেন হল

লাল ইটের তৈরি টিনের ছাউনি দেওয়া এ ভবনেই সংবর্ধিত হয়েছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনায় আটক ও পরে মুক্তি পাওয়া বিপ্লবীরা। এ ভবন থেকেই শুরু হয় চট্টগ্রামের অসহযোগ আন্দোলন।

আন্দোলনে যোগ দেয়া চা-শ্রমিকদের উপর ব্রিটিশ পুলিশ গুলি চালালে সংহতি জানানো রেল শ্রমিকরা এ ভবন ও আশপাশের এলাকাতেই তাঁবু টানিয়ে ধর্মঘট চালিয়ে গিয়েছিলেন।

ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের নানা বাঁকবদলের সাক্ষী চট্টগ্রামের প্রথম টাউন হলখ্যাত যাত্রা মোহন সেন (জে এম সেন) হল দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষের সীমানায়।

যার নামে এই ভবন সেই যাত্রা মোহন সেনগুপ্তের হাত ধরেই চট্টগ্রামে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বেগবান হয় বলে ইতিহাসবিদরা জানাচ্ছেন।

আবদুল হক চৌধুরীর লেখা ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ এ বলা হয়েছে, আন্দোলন জোরদার করতে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অনুকরণে ‘দি চিটাগাং অ‌্যাসোসিয়েশন’ নামের একটি সংগঠন ও ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেন কংগ্রেস নেতা ও আইনজীবী যাত্রা মোহন সেনগুপ্ত।

১৯১৪ সালে রহমতগঞ্জে নিজের টাকায় জমি কিনে তাতে ‘চট্টগ্রাম টাউন হল’ বানাতে তিনি চিটাগাং অ‌্যাসোসিয়েশনকে দান করেন তিন হাজার টাকা।

দুই বছর পর সেখানেই ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয় জানিয়ে সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেন, “১৯১৬ সালের ১৯ নভেম্বর জে এম সেন হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন আমার প্রমাতামহ রায় বাহাদুর শরৎচন্দ্র দাশ।”

নির্মাণকাজ চলার সময়ই ১৯১৯ সালের ২ ডিসেম্বর যাত্রা মোহন সেনগুপ্ত মারা যান। পরের বছর ৮ ফেব্রুয়ারি হলের উদ্বোধন করেন রায় বাহাদুর নবীনচন্দ্র দত্ত।

এরপর পিতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কংগ্রেস নেতা দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত হলটির নতুন নাম রাখেন ‘যাত্রা মোহন সেন হল’, পরে যা জে এম সেন হল নামে পরিচিতি পায়।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই চট্টগ্রামে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে জে এম সেন হলের নাম।

দৈনিক আজাদীর ৩৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ প্রকাশনা ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ এর তথ‌্য অনুযায়ী, ১৯২০ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের যে বিশেষ অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়, সেখানে চট্টগ্রামের নেতারাও ছিলেন।

অধিবেশন থেকে ফিরেই জেএম সেন হলে সভা করে ধর্মঘটি ছাত্র-জনতা। মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সভাপতিত্বে ওই সভা থেকেই চট্টগ্রামজুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের রূপরেখা প্রস্তুত হয়।

আন্দোলন বেগবান করতে হলের কাছেই স্থাপন করা হয় জাতীয়তাবাদীদের প্রতিষ্ঠান ‘স্বরাজ সংঘ’।

অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়া চা-বাগান শ্রমিকরা বাগান ছেড়ে নিজ এলাকায় ফিরতে চাইলে তাদের কাছে টিকেট বিক্রি বন্ধ করে দেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

পরে চাঁদপুর স্টিমারঘাটে ব্রিটিশ পুলিশ চা শ্রমিকদের ওপর গুলি চালালে রেল শ্রমিকরাও আন্দোলনে সংহতি জানায়। তারা আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সদরদপ্তর চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত রেল ধর্মঘটের ডাক দেয়।

“রেল কর্তৃপক্ষ ধর্মঘটে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের কোয়ার্টার ছাড়ার আদেশ দিলে শ্রমিকরা জে এম সেন হল এবং এর আশেপাশে তাঁবু খাটিয়ে থাকতে শুরু করেন,” বলেন অনুপম সেন।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে থাকা বিপ্লবীদেরও জে এম সেন হলে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল বলে জানান ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক সাময়িকী ‘ইতিহাসের খসড়া’র সম্পাদক মুহাম্মদ শামসুল হক।

তিনি বলেন, “১৯৪৬ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনায় আটক বিপ্লবীরা মুক্ত হলে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয় এ হলে।”

পাকিস্তান আমলের শুরুতে ভাষার প্রশ্নে এ ভবনকে ঘিরেই চলে চট্টগ্রামের আন্দোলন।

শামসুল হক বলেন, ১৯৪৮ সালে তমদ্দুন মজলিস ভাষা আন্দোলন বেগবান করতে ‘সৈনিক’ পত্রিকা প্রকাশে তহবিল সংগ্রহের জন‌্য ভারতের বিখ্যাত যাদুকর পিসি সরকারকে এনে এ হলে তিন দিনব্যাপী জাদু প্রদর্শনী করে। পূর্ব পাকিস্তানের সেই সময়ের কবিয়াল সমিতির সম্মেলনও এ হলেই হয়।

ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে গত দশকের শেষ দিক পর্যন্ত রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সভা-সম্মেলন হয়েছে এ হলপ্রাঙ্গণে।

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ এ হলে সভা করে মহিলা আওয়ামী লীগ। মেহেরুন্নেছা, বেগম শরাফত উল্লাহ, নাজনীন বেগম, কামরুন্নাহার, কুন্দপ্রভা সেন ও বেগম মুছা খান অংশ নেন সেই সভায়।

১৯৮৪ সাল থেকে জে এম সেন হলে জন্মাষ্টমী উৎসব শুরু করে জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ। এরপর সেখানে দুর্গা পূজা, সরস্বতী পূজা, রাস উৎসব, কঠিন চীবর দানসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান হয়ে আসছে বলে শামসুল হক জানান।

কালের সাক্ষী এ হল প্রাঙ্গণের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এখনও পাওয়া যায় ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। সেখানে আবক্ষমূর্তিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন, আইনজীবী-কংগ্রেস নেতা যাত্রা মোহন সেনগুপ্ত, কংগ্রেস নেতা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নেলী সেনগুপ্তা ও রাজনীতিবিদ-সাংবাদিক মহিমচন্দ্র দাশ।

পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বি হল ঘরের মূল প্রবেশ পথ পশ্চিমমুখী। উত্তর-দক্ষিণে তিনটি করে ছয়টি এবং পূর্ব-পশ্চিমে একটি করে দুটিসহ মোট আটটি প্রবেশপথ  রয়েছে।

পশ্চিমমুখী মূল দরজার ওপরে লেখা মিলনায়তনের নাম- ‘যাত্রা মোহন সেন হল’, পাশেই দ্বিতীয় তলায় ওঠার কাঠের সিঁড়ি।

কাঠের খুঁটির ওপর দাঁড়ানো দ্বিতীয় তলাতেও আছে বসার ব‌্যবস্থা। হলের মোট দর্শক ধারণক্ষমতা পাঁচশ।

নিয়মিত সংস্কার না হওয়ায় ইতিহাসের সাক্ষী এ হলের আগের জৌলুস আর নেই।

আশপাশে গড়ে ওঠা উঁচু উঁচু ভবনের কারণে পুরনো জে এম সেন হলের ভেতরে এখন পর্যাপ্ত আলো মেলে না। দিনের বেলাতেও বাতি না জ্বালালে হলের ভেতর থাকে গাঢ় অন্ধকার।

খুঁটি আর প্রবেশদরজাগুলোও বয়সের ভারে ন্যুজ, উঠে গেছে রং, পলেস্তরা। কাঠের সিঁড়িগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। টিনের চালের সংস্কার হয়নি বহুদিন।

শতবর্ষী এ হলকে আবারও ব্যবহারউপযোগী করে তোলার দাবি দীর্ঘ দিনের। কিন্তু চিটাগাং অ্যাসোসিয়েশন কিংবা অন্যান্য সরকারি সংস্থার এ বিষয়ে উদ্যোগ নেই।

চিটাগাং অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানান, জ‌্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকের মৃত্যু হওয়ায় হলটির সংস্কার ও স্মৃতি সংরক্ষণ কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে।

অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক রণজিৎ দে বলেন, বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী ছিলেন কমিটির সভাপতি। তিনিসহ কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য মারা গেছেন। কমিটি পুনর্গঠনের জন্য শুক্রবার সভা ডাকা হয়েছে।

সেখানে হল সংস্কারসহ অন্যান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন