শ্রীরামকৃষ্ণের ষোড়শীপূজার তাৎপর্য

স্বামী তত্ত্ববিদানন্দ

দশ মহাবিদ্যার অন্যতম ষোড়শী। তাঁর নামান্তর শ্রীবিদ্যা, ত্রিপুরা, সুন্দরী, ত্রিপুরসুন্দরী, মহাত্রিপুরসুন্দরী, ললিতা ইত্যাদি। দেবী ষোড়শীর আবির্ভাব সম্বন্ধে নারদপঞ্চরাত্রে বর্ণিত হয়েছে, ‘একবার স্বর্গের অপ্সরারা কৈলাসে মহাদেবকে দর্শন করতে যান। শিব তাঁদের সামনেই দেবীকে কয়েকবার কালী কালী বলে ডাকেন। এতে দেবী লজ্জা পেয়ে যান এবং মনে মনে স্থির করেন কালীরূপ ত্যাগ করে বিশুদ্ধ গৌরীরূপ ধারণ করবেন। এমন সংকল্প করে দেবী কৈলাস থেকে অন্তর্হিতা হয়ে যান। শিব তখন একা। এমন সময়ে একদিন নারদ উপস্থিত। শিবকে একা দেখে দেবর্ষি তাঁকে দেবীর কথা জিজ্ঞাসা করলেন। শিব বললেন, “দেবী আমাকে ত্যাগ করে অন্তর্হিতা হয়েছেন।” নারদ ধ্যানস্থ হয়ে দেখলেন দেবী সুমেরুর উত্তর পার্শ্বে অবস্থান করছেন। তিনি তখনি সেখানে চলে গেলেন এবং অনেক স্তবস্তুতি করে দেবীকে প্রসন্ন করলেন। দেবী নারদকে শিবের সংবাদ জিজ্ঞাসা করলেন। নারদ বললেন, “মা, মহেশ্বর আবার বিবাহের উদ্যোগ করছেন। তুমি শীঘ্র গিয়ে তা বন্ধ কর।” দেবী তখন এমন অপূর্ব সুন্দর রূপ ধারণ করলেন কোথাও যার তুলনা মিলে না এবং মুহূর্তমধ্যে শিবসান্নিধানে উপস্থিত হয়ে শিবের হৃদয়ে নিজের ছায়া দেখতে পেলেন। ভাবলেন ইনি বোধহয় অন্য কোনও দেবী। সেইজন্য অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শিবকে অকৃতজ্ঞ প্রতিজ্ঞাভঙ্গকারী ইত্যাদি বলে তিরস্কার করতে লাগলেন। শিব বললেন — “দেবী, ধ্যানস্থ হয়ে জ্ঞানদৃষ্টিতে দেখ, দেখবে আমার হৃদয়ে তোমারই ছায়া !” দেবী তাই করলেন এবং ছায়াটি যে তাঁর নিজেরই ছায়া তা দেখে শান্ত হলেন। এবার দেবী শিবকে সেই ছায়ার তত্ত্ব জিজ্ঞাসা করলেন। শিব উত্তরদান প্রসঙ্গে বললেন —. “ত্রিভূবনে সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ ধারণ করেছ বলে তুমি স্বর্গে মর্ত্যে পাতালে এবং অন্যত্র সুন্দরী পঞ্চমী শ্রী এবং ত্রিপুরসুন্দরী নামে প্রসিদ্ধ হবে আর সর্বদা ষোড়শবর্ষীয়া বলে ষোড়শী বলে খ্যাত হবে” । ‘ বামকেশ্বর তন্ত্রে বলা হয়েছে — ত্রিপুরা পরমা শক্তি। তিনি জ্ঞাতৃ, জ্ঞান ও জ্ঞেয়— রূপে জগতের আদ্যা। তিনি স্থূল, সূক্ষ্ম ও ত্রৈলোক্যের জনয়িত্রী জননী। দেবী ষোড়শীকেই আবার বলা হয় শ্রীবিদ্যা, যেহেতু তিনি সর্বদা শ্রী প্রদান করেন।

শাক্ত তন্ত্রসম্মত শক্তিসাধনায় দুটি ধারা — একটি কালীকুল, অপরটি শ্রীকুল। কুল শব্দের অর্থ এখানে সম্প্রদায়। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি, তত্ত্বস্বরূপ সম্বন্ধে মতপার্থক্য তান্ত্রিক আচারে ভিন্নতাই এই দুই সম্প্রদায় প্রবর্তিত হওয়ার মূলে। যাঁরা কালীকুলের উপাসক তাঁদের মতে দেবী কালিকা আদ্যাশক্তি, পরব্রহ্মস্বরূপিনী। তিনিই সর্বদেবপ্রসবিনী এবং সকল দেবতার আরাধ্যা। ভারতের পূর্বাঞ্চলের শক্তি উপাসকরা মূলত কালীকুলের উপাসক এবং দেবী কালিকাই তাঁদের উপাস্যা। দক্ষিণ ভারতের শক্তিসাধকরা শ্রীকুলের উপাসক ।যেহেতু এই কুলের আরাধ্যা দেবী শ্রীবিদ্যা সেইজন্য এই সম্প্রদায়ের নাম শ্রীকুল। অথবা দার্শনিক বিচারে এই কুলের অনুগামীরা যেহেতু বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী শ্রীকন্ঠের অনুগামী তাই তাঁদের নাম শ্রীকুল।

আবার কালীকুল ও শ্রীকুল শব্দের অন্য ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। নিরুত্তরতন্ত্রে বলা হয়েছে যে কালীকুল ও শ্রীকুল হল নির্দিষ্ট কয়েকজন দেবতার সমষ্টি। কালী, তারা, রক্তকালী, ভুবনেশ্বরী, মহিষমর্দিনী, ত্রিপুরা, ত্বরিতা, দুর্গা, বিদ্যা ও প্রত্যঙ্গিরা — এরা হলেন কালীকুলের দেবতা। আর শ্রীকুলের দেবীবৃন্দ হলেন — সুন্দরী, ভৈরবী, বালা, বগলা, কমলা, ধূমাবতী, মাতঙ্গী, বিদ্যা-স্বপ্নাবতী, মধুমতী ও মহাবিদ্যা।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন