
ভক্তি মানেই ভাবের খেলা ৷ ধ্যান, জপ, পুজো, ভজন — ভাব না থাকলে সব বৃথা।
ভাব না থাকলে জপ, হোম, তন্ত্র-মন্ত্র সব শুধু কায়ক্লেশ মাত্র, পণ্ডশ্রম ৷ ভাববিহীন পুজো পুজো নয় ৷ ভাববিহীন জপ জপ নয়, সে তো বাড়ির পোষা পাখিও অনেক সময় ঠাকুর-দেবতার নাম করে ৷ তাঁর নাম যখন করব, ভাবের সাথে করব, প্রেমের সাথে করব ৷ নাম করতে করতে আনন্দ হবে, চোখ দিয়ে জল এসে যাবে ৷ তাঁর ধ্যান করব — ভাবব, তিনি প্রসন্ন-দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছেন, আমার কত কাছে রয়েছেন তিনি, আমার আপনার জন — একমাত্র আপনার জন ৷ তবেই তো, ধ্যান করে আনন্দ পাব ৷
এই যে লোকে তীর্থে যায়, মনটা যদি তৈরি না থাকে তাহলে তীর্থে গিয়ে লাভ কি ?একটা গল্প আছে :
এক বৃদ্ধা পুরী যাচ্ছেন জগন্নাথ দর্শন করতে ৷ পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন ৷ সারা রাস্তা তাঁর দুশ্চিন্তার শেষ নেই — বাড়িতে নতুন লাউগাছ হয়েছে, বৌমা তো ছেলেমানুষ, সে ঠিকমতো দেখাশুনা করবে তো ? গরু-ছাগলে খেয়ে নেবে না তো ! পুরী পৌঁছে যখন বিগ্রহ দেখার সময় হল, তখন তিনি জগন্নাথকে দেখতে পেলেন না — সেই জায়গায় দেখলেন লাউগাছ ৷
তীর্থে যাওয়ার প্রয়োজন কি ? প্রয়োজন এই যে, এতে ভগবানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, উদ্দীপন এনে দেয় ৷ যাঁর মন তৈরি মন, তাঁর সহজেই উদ্দীপন এসে যায় ৷ আর যাঁর মন তৈরি হয়নি, তীর্থস্থানে গেলেও তাঁর উদ্দীপন হবে না ৷ ঠাকুরের মন যেমন তৈরি ৷ যা কিছু দেখছেন তাতেই ঈশ্বরীয় ভাবের উদ্দীপন হচ্ছে ৷ বারবনিতা দেখছেন — অমনি জগজ্জননীকে মনে পড়ে যাছে তাঁর ৷ ইংরেজ-ছেলে ত্রিভঙ্গ মূর্তিতে দাঁড়িয়ে আছে — শ্রীকৃষ্ণের কথা মনে পড়ছে তাঁর ৷ চিড়িয়াখানায় সিংহ দেখছেন, সিংহবাহিনীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ৷ ব্রহ্মের প্রকাশ দেখছেন সর্বত্র ৷ মনটা যদি তৈরি থাকে, উঁচু সুরে বাঁধা থাকে — তাহলে যা দেখি তাতেই উদ্দীপন হয় ৷
মন্ত্র, তীর্থ, দ্বিজ, দেবতা, দৈবজ্ঞ, ভেষজ আর গুরু — এই কয়টিকে যে যেমনভাবে দেখবে সে তেমন ফল পাবে ৷ ওষুধে যার বিশ্বাস থাকবে, সে বেশি ফল পাবে ৷ তেমনি মন্ত্র, গুরুবাক্য ইত্যাদিতে যার বেশী বিশ্বাস, সে বেশী ফল পাবে ৷ যার যেমন ভাব তার তেমন লাভ ৷ ভাববিহীন পূজা, ভাববিহীন স্তোত্রপাঠ, ভাববিহীন ভজন — নিষ্প্রাণ বলে মনে হয় ৷ ভাবই হচ্ছে আসল ৷ সেই ভাব যেখানে আছে, সেখানেই আনন্দ ৷
স্বামী লোকেশ্বরানন্দ