জীবাত্মা ও পরমাত্মার নিত্য খেলা

বিশ্ব প্রকৃতির দিকে নিবিড় দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যায় সৃষ্টি জগতে দু’টো শক্তিই কাজ করে। একটি ভুক্তা, অপরটি ভোগী। অর্থাৎ খাদ্যও খাদক। প্রকৃতির রাজত্বে সৃষ্টিকর্তার বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য এভাবেই রক্ষা পাচ্ছে। সৃষ্টিতেই সৃষ্ট প্রাণী বস্তু সকল বিলিন হচ্ছে। শাস্ত্রীয় বিধানে বলা চলে, জীবাত্মা ও পরমাত্মার নিত্য খেলা। দু’টো শক্তি আবার একে অন্যে আকর্ষিত হয়ে প্রেমভাবে মিলন ঘটাই স্বাভাবিক। চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী, গ্রহ, তারা, আলো-বাতাস প্রকারান্তরে ঘূর্ণন পথে বিচরণ করছে। তারা সবাই চলমান, চলন্ত ও চলন্তিকা।
‘যাত্রা’ শব্দটি এসব তাৎপর্য মন্ডিত বিশেষ অর্থে সাধারণ অর্থ বহন করে না। আমরা সাধারণত যাত্রা বলতে পথ চলা বা গমন বলেই জানি। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। আসলে যাত্রা বলা হয় কোনো লক্ষ্যবস্তু বা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কোনো নির্দিষ্ট স্থান থেকে নির্ধারিত পথে অভিষ্ট স্থানে পৌঁছে যাওয়াকেই।
এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, পরমপুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবার ‘যাত্রা কিসের? তাঁর গমনাগমনই বা কী? কিন্তু না, শাস্ত্রীয় বিধানে তত্বগত দিক দিয়ে ধরা ধামে নরদেহ ধারন করে পরমপুরুষ যখন অবতীর্ণ হয়ে থাকেন, লোক শিক্ষার লীলা সম্পাদন প্রসঙ্গে তাঁকে কার্যোপলক্ষে গমনাগমন করতেই হয়। ভক্তের কাছে আসতেই হয়। এভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বাদশ যাত্রার কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, কিন্তু আমরা সবগুলো পালন করি না, করা সম্ভবও নয়। কিছু কিছু বিশেষ উল্লেখযোগ্য যাত্রানুষ্ঠান নিয়মিতভাবেই অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়, যেমন- রথযাত্রা, রাসযাত্রা, দোলযাত্রা, স্নানযাত্রা, ঝুলনযাত্রা ইত্যাদি।
শাস্ত্রকাররা এসব যাত্রাগুলোকে বিশেষ তাৎপর্যমন্ডিত ও তত্বসমৃদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন। অনাদি কাল থেকেই শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহ রূপে মন্দিরে দেবালয়ে, ভক্তের গৃহে স্থায়ীভাবে পূঁজিত হয়ে আসছেন। এখনও হচ্ছেন। কিন্তু তাঁর লীলা প্রকাশে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে যেসব যাত্রানুষ্ঠান স্বয়ং উদযাপন করেছিলেন এগুলো ভক্তের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়ে আজও পুন্যানুষ্ঠান হিসেবে গণ্য।
পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ভক্তদের সাথে মেলামেশা ও লীলায় মত্ত হয়ে দেবালয় বা মন্দির থেকে বাহিরে চলে আসেন, ভক্তদেরে সংস্পর্শে অতি নিকটে অবস্থান করেন। বহিরাঙ্গিঁক দিক থেকে ভাবভক্তি ও আত্মনিবেদনের সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে ভক্তরা ধন্য হয়ে যান।
তাত্ত্বিক কথাটি হচ্ছে-এমন আনন্দঘন রসিক শেখর তো প্রতিটি মানবের দেহরূপী খাচায় পরমাত্মা রূপেই সদা বিরাজমান। আবার জীবাত্মারূপী প্রকৃতির সাথে সদা সর্বদা মেতেই আসেন।
রাধা গোবিন্দের ঝুলনযাত্রানুষ্ঠানটিও বহিরাঙ্গিকভবে তেমনি তাৎপর্যমন্ডিত। যেহেতু তাঁকে বলা হয় ‘পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, তাঁর এই ঝুলনযাত্রা অনুষ্ঠানটি উদযাপিত হয় শাস্ত্রবিধির ‘পুরুষোত্তম’ মাসটিতে। অর্থাৎ শ্রাবণ মাসেই। শ্রাবণ মাসের একাদশী তিথি থেকে আবম্ভ হয়ে পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত পাঁচ-দিন ব্যাপি এই অনুষ্ঠানটি উদযাপন করা হয়।
রাধা কৃষ্ণের বিগ্রহ কুর্শি বা ঝুলনা বা দুলনায় স্থাপন করে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ঝুলান হয়। এখানে প্রতীকী হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন-পরা প্রকৃতি বা পুরুষোত্তম আর রাধারাণী হচ্ছেন-অপরা প্রকৃতি ভক্ত স্বরূপিনী।
সুক্ষ্ম অর্থে ভক্ত ভগবানের খেলা।
প্রশ্ন জাগতে পারে দোলায় রাধা গোবিন্দের বিগ্রহ স্থাপন করে পূর্বপশ্চিম দিক দিয়ে ঝুলানোর তাৎপর্য কী? এ বিষয়ে, শাস্ত্রিয়, ভৌগোলিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। এ অনুষ্ঠানে দোলনাটি ঝুলানো হয় পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে। সূর্যের উদয় অস্ত ও অবস্থানের দিক নির্দিষ্ট করেই তা করা হয়। সূর্য হচ্ছে পৃথিবীতে সর্ব প্রকার শক্তির উৎস। আর পৃথিবীর গতি ধারা হচ্ছে-দু’টো। আহ্নিকগতি ও বার্ষিক গতি। দু’টো গতির গতিধারায় বছরে দুবার কর্কট ক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখায় গিয়ে অবস্থান করে। তখন ঘটে সূর্যের উত্তরায়ন ও দক্ষিণায়ন অবস্থান। তখন শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা অনুষ্ঠানে দোলনাটিকে ঝুলানো হয় উত্তর দক্ষিণ দিকে।
রাধা কৃষ্ণের ঝুলনযাত্রা অনুষ্ঠানটি কবে কোনো সময়ে সর্ব প্রথম আরম্ভ করা হয়েছিল।
নির্ধারণ করা বড়ই কঠিন। তবে শাস্ত্র ধারণা মতে, এ অনুষ্ঠানটি সম্ভবত এগারো দশকে দ্বাপর যুগেই আরম্ভ হয়েছিল। যেমন বাল-কৃষ্ণ গোপালকে দোলনায় তুলে মা যশোদা ঝুলাতেন। পরবর্তীতে এটা নন্দালয়ের পরিসীমা অতিক্রম করে। তখন গো-রাখাল কৃষ্ণের সঙ্গীঁ সাথীরা গো চরাতে বলে জঙ্গঁলে, বড় বড় গাছের ডাল থেকে ঝুলানো তলায় মাঁচা বেঁধে তাতে গোপালকে বসিয়ে খেলা করত। তারপর কিশোর গোপালকে নিয়ে গোপ সখা সখিরা সুন্দর সুন্দর ফুল পুষ্পমালা দিয়ে বালককে সাজিয়ে আনন্দ উপভোগ করতেন। তৎকালীন সময়েই শ্রীকৃষ্ণের এমন বয়সে তার বাল্যলীলা সমৃদ্ধ ঘটনাবলীর মাধ্যমেই তিনি অনাদির আদি গোবিন্দ পরম পুরুষ হিসেবে ধরা পড়েন। পরবর্তীতে অবতারীর অবতার রহস্যের বিকাশ ঘটতেই থাকে।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন