
নীল বা নীলকণ্ঠ মহাদেব শিবের অপর নাম। সেই নীল বা শিবের সাথে নীলচণ্ডিকা বা নীলাবতী পরমেশ্বরীর[১] বিয়ে উপলক্ষ্যে লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান সংঘটিত হয়। কাহিনি অনুসারে, দক্ষযজ্ঞে দেহত্যাগের পর শিবজায়া সতী পুনরায় সুন্দরী কন্যারূপে নীলধ্বজ রাজার বিল্ববনে আবির্ভূত হন। রাজা তাকে নিজ কন্যারূপে লালন-পালন করে শিবের সাথে বিয়ে দেন। বাসর ঘরে নীলাবতী শিবকে মোহিত করেন এবং পরে মক্ষিপারূপ ধরে ফুলের সঙ্গে জলে নিক্ষিপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন; রাজা-রাণীও শোকে প্রাণবিসর্জন দেন। নীলপূজা শিব ও নীলাবতীরই বিবাহ-অনুষ্ঠানের স্মারক।
নিম বা বেল কাঠ থেকে নীলের মূর্তি তৈরি হয়। চৈত্রসংক্রান্তির বেশ আগেই নীলকে মণ্ডপ থেকে নিচে নামানো হয়। নীলপূজার আগের দিন অধিবাস; অধিক রাত্রে হয় হাজরা পূজা অর্থাৎ বিয়ে উপলক্ষে সকল দেবতাকে আমন্ত্রণ করা। হাজরা পূজায় শিবের চেলা বা ভূত-প্রেতের দেবতাকে পোড়া শোল মাছের ভোগ দেওয়া হয়। পরদিন নীলপূজার সময় নীলকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে নতুন লালশালু কাপড় পরিয়ে অন্ততপক্ষে সাতটি বাড়িতে নীলকে ঘোরানো হয়।
নীলসন্ন্যাসীরা একইরকম লাল কাপড় পরে পাগড়ি মাথায়, গলায় রুদ্রাক্ষমালা ও হাতে ত্রিশূল নিয়ে নীলকে সঙ্গে করে এই মিছিল করেন। এদের দলপতিকে বলা হয় বালা। সাথে থাকে ঢাক-ঢোল, বাঁশী বাজনদারের দল এবং কাল্পনিক শিব-দুর্গার সাজে সঙেরা। গৃহস্থ মহিলারা উঠানে আল্পনা দিয়ে নীলকে আহ্বান করে বরাসনে বসিয়ে তার মাথায় তেলসিঁদুর পরিয়ে দেন। এরপর নীলের গান শুরু হয়:
“শুন সবে মন দিয়ে হইবে শিবের বিয়ে
কৈলাসেতে হবে অধিবাস।
(ও) তাতে নারদ করে আনাগোনা কৈলাসে বিয়ার ঘটনা
বাজে কাঁসী বাঁশী, মোহন বাঁশরী।”
“(ও) নারদ চলল গিরি রাজের গৃহেতে।
আর একদিনেতে শূলপাণি, নারদকে বলেন বাণী
শুনো নারদ শুনো আমার সাধ,
আমি দুই পাশে দুই বালিশ দিয়ে, মধ্যিখানে থাকি শুয়ে
উশিপুসি করে কাটাই রাত।।
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
আর ওই শিব কয় কৈলাসে যেয়ে, দেখে এসেছি মেয়ে
শীঘ্র করো বিয়ের আয়োজন,
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
চলিলেন নারদ মুনি, চলিলেন নারদ ধনি
উপনীত গিরি পুরে যেয়ে।
কইলেন মেনকা রানী, আইলেন নারদ মুনি
দেখা পেয়ে এল মুনির ঠাঁই।।
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
শোনো ওগো গিরি রাজা, হইবা আমার আজা
জামাই তোমার হবে দিগম্বর।।”
বিয়ের ঘটক ভাগিনেয় নারদ মুনির কাছে শিব আর্তি জানান,
“ভাইগনা যদি উপকারী হও।
তবে বিয়া দিয়া আমার প্রাণ বাঁচাও।।”
বিয়ের পর নীলের গানে থাকে সংসারী হর-পার্বতীর কথা, শিবের কৃষিকাজ, গৌরীর শাঁখা পরা প্রভৃতি এবং ভিখারি শিবের সঙ্গে অন্নপূর্ণা শিবানীর দ্বান্দ্বিক সহাবস্থানের কাহিনি। গানের প্রথম অংশ দলপতি বালারা এবং পরবর্তী অংশ অন্য নীলসন্ন্যাসীরা গেয়ে থাকেন।
গানের শেষে গৃহস্থরা সন্ন্যাসীদের চাল-পয়সা, ফল প্রভৃতি ভিক্ষাস্বরূপ দেয়।[২]
ঐদিন সন্তানবতী হিন্দু নারীরা সারাদিন উপবাস রেখে সন্তানের আয়ু বৃদ্ধির কামনায় ‘নীল ষষ্ঠী’র ব্রত করে। নীলপূজার পর সন্ধ্যাবেলায় শিবমন্দিরে বাতি দিয়ে জলগ্রহণ করে।। প্রেরকঃ বাবু গৌতম বিশ্বাস।