দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ

দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে অন্যতম হল মল্লিকার্জুন জ্যোতির্লিঙ্গ। অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীশৈল পর্বতে এই জ্যোতির্লিঙ্গ অবস্থিত। শ্রীশৈল যা শ্রীশৈলম নল্লামলা পর্বতশৃঙ্খলার একটি অংশ। শ্রীশৈলকে দক্ষিণের কৈলাসও বলা হয়। হায়দ্রাবাদ থেকে ২১২ দূরে কুর্নুল জেলার আটমাকুরে নাল্লা পর্বতে শ্রীশৈলম। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কৃষ্ণা নদী। সাধারণ গর্ভগৃহের তুলনায় বেশ ছোট, কুচকুচে কালো মসৃণ মাত্র ২৫ – ৩০ সেন্টিমিটার উঁচু শিবলিঙ্গটি। মাথায় রূপোর নাগরাজ। মন্দিরটি পূর্বমুখী। কেন্দ্রীয় মণ্ডপে অনেকগুলি স্তম্ভ এবং নন্দীকেশ্বরের একটি বিরাট মূর্তি আছে। মহাশিবরাত্রি এই মন্দিরের প্রধান উৎসব। প্রতিবছর জামজমকের সাথে এই অনুষ্ঠান পালিত হয়।

পুরাণ অনুযায়ী এই জ্যোতির্লিঙ্গে শিব ও পার্বতী একসঙ্গে বিরাজমান। যে কারণে এই শিবলিঙ্গের আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্য বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। শিব ও শক্তি উভয়ের আরাধনা হয় এই জ্যোতির্লিঙ্গে। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে সতীর অপর নাম হল মল্লিকা, আর অর্জুন শব্দের অর্থ ‘উজ্জ্বল’, ‘জাজ্বল্যমান’, ‘সাদা’ অথবা ‘রূপালি’। অর্থাৎ শিবের জ্যোতির্লিঙ্গের এমনই ছিল। পুরাণ অনুযায়ী মল্লিকার্জুন জ্যোতির্লিঙ্গের দর্শন মাত্রে ভক্তদের সমস্ত পাপ দূর হয় ও তাঁরা মোক্ষ লাভ করে থাকে। শ্রাবণ মাসে এই মন্দিরে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়।

শিব পুরাণ অনুযায়ী, একদা শিব ও পার্বতী উভয়ে গণেশ এবং কার্তিকের বিবাহ প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলেন। দুই পুত্রই অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী ছিলেন এবং সেই সঙ্গে বিবাহের জন্য ব্যাকুলও ছিলেন। তখন শিব ও পার্বতী নিশ্চিত করেন যে, দুজনের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা করা হবে। যে এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হবে, তাঁর বিবাহ আগে করে দেবেন তাঁরা। প্রতিযোগিতা হল যে প্রথমে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে ফিরে আসবে তাঁর বিবাহ প্রথমে হবে। এ কথা শোনার পরই কার্তিক নিজের বাহন ময়ূরের পিঠে সওয়ার হয়ে পৃথিবী প্রদক্ষিণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান। এদিকে প্রখর বুদ্ধি সম্পন্ন গণেশ নিজের বাহন মূষিকের পিঠে বসে সাত বার শিব-পার্বতীর প্রদক্ষিণ করেন তিনি। গণেশ বলেন, মা-বাবাই তাঁর সমগ্র পৃথিবী, তাঁদের পরিক্রমা করে তিনি সমগ্র পৃথিবীর প্রদক্ষিণ সম্পন্ন করেন।

গণেশের ভক্তি, প্রেম, বুদ্ধিমত্তা থেকে শিব ও পার্বতী খুশি হন ও তাঁকে প্রতিযোগিতায় জয়ী ঘোষণা করেন। তার পর রিদ্ধি ও সিদ্ধির সঙ্গে গণেশের বিবাহ দেন তাঁরা। এদিকে পৃথিবীর পরিক্রমা করে ফিরে আসার পর কার্তিক এই দেখে ক্রুদ্ধ হলেন এবং বরাবরের মত কৈলাস ছেড়ে ক্রৌঞ্চ পর্বতে কুমারব্রহ্মচারী নামে বসবাস করতে চলে যান ও সেখানে তপস্যা শুরু করেন। এই ঘটনায় মহাদেব ও পার্বতী বিষন্ন হলেন। তারা পুত্র কার্তিককে দেখতে ক্রৌঞ্চ পর্বত পরিদর্শন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু কার্তিক যখন বুঝতে পারলেন, তাঁর বাবা মায়ের আগমন হবে, তিনি তখন অন্যত্র চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেবতাদের অনুরোধে তিনি কাছাকাছিই থেকে যান। কার্তিক একান্তে তপস্যা করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে পাশের কৌমারী পর্বতে চলে যান। পুত্রের দেখা না পেয়ে মহাদেব ও পার্বতী সেখানেই অপেক্ষা করতে থাকেন। শিব ও পার্বতী সেখানেই বাস করার সিদ্ধান্ত নেন। শিব ও পার্বতী যেখানে ছিলেন সেই জায়গাটি শ্রীশৈলম নামে পরিচিত হয়। শিব অমাবস্যায় ও পার্বতী পূর্ণিমায় কার্তিককে পরিদর্শনে আসতেন। পরবর্তীকালে কার্তিক নিজের মা-বাবার ভক্তি স্বীকার করেন, কিন্তু তিনি শ্রীশৈলমের কাছেই বসবাস শুরু করেন।

মল্লিকার্জুন জ্যোতির্লিঙ্গের মাহাত্ম্য হল এই জ্যোতির্লিঙ্গ শুধু শিবের প্রতীক নয়, বরং পার্বতীর সঙ্গে তাঁর ঐক্যকেও প্রকট করে। এই স্থানটি শিব-শক্তির মিলনের প্রতীক। যা সৃষ্টির সৃজন, পালন ও সংহারের প্রকাশ ঘটায়। কৃষ্ণা নদীর তীরে এই জ্যোতির্লিঙ্গ অবস্থিত। এই নদীতে স্নান করলে ভক্তদের আত্মা শুদ্ধ হয়। এই জ্যোতির্লিঙ্গের দর্শন করলে ব্যক্তির জীবন থেকে সমস্ত ধরনের দুঃখ, কষ্ট, রোগ সমাপ্ত হয়। আবার শিব পুরাণ অনুযায়ী এই জ্যোতির্লিঙ্গের দর্শন মাত্রে ব্যক্তি মোক্ষ লাভ করতে পারে। উল্লেখ্য আদি শঙ্করাচার্য শ্রীশৈলমে তপস্যা করে সেখানে শ্রীচক্র স্থাপন করেন। শিব পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ-সহ অন্যান্য পৌরাণিক গ্রন্থে এই জ্যোতির্লিঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়।

মল্লিকার্জুন জ্যোতির্লিঙ্গের নিয়ে অবশ্য আরও একটি কিংবদন্তী শোনা যায়। সেটি চন্দ্রগুপ্তের কন্যা রাজকুমারী চন্দ্রাবতীকে নিয়ে। কাহিনিটি মল্লিকার্জুন জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের দেওয়ালে খোদাই করা আছে।

চন্দ্রাবতী রাজকন্যা হিসেবে জন্মগ্ৰহন করেছিল কিন্তু রাজকীয় জীবন ত্যাগ করে প্রায়শ্চিত্তর জীবন যাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি যখন কদলী বনে ধ্যান মগ্ন ছিলেন তখন তিনি দেখেন কপিল গাভী একটি বেল গাছের নিকট উপস্থিত হল, গাভীর চারটি বাট দিয়ে অনর্গল দুধ বেরিয়ে সেই জায়গাটি ভিজে যায়। প্রতিদিন এই জিনিস চলতে থাকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ়, রাজকুমারী গাছের তলার মাটি খুঁড়তে শুরু করলেন। এখানেই তিনি “স্বয়ম্ভ শিবলিঙ্গ” পেলেন। শিবলিঙ্গটি উজ্জ্বল এবং জ্বলন্ত ছিল।

চন্দ্রাবতী এই জ্যোতির্লিঙ্গের উপাসনা করেন এবং অবশেষে একটি বিশাল জ্যোতির্লিঙ্গের মন্দির তৈরী করেন। কথিত আছে যে, চন্দ্রাবতী শিবের খুব প্রিয় ভক্ত ছিলেন। অন্তিমকালে, তিনি বাতাসের দ্বারা কৈলাসে বাহিত হয়ে সেখান থেকে মোক্ষ ও মুক্তি পান। এটা বিশ্বাস করা হয় যে এখানে শিবের কাছে প্রার্থনা করলে অপরিমেয় সম্পদ ও খ্যাতি অর্জিত হয়। শিবের কাছে সৎমনে ও নিষ্ঠা ভরে কিছু চাইলে সবরকমের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়।

শ্রী মল্লিকার্জুন স্তোত্রঃ —

শ্রীশৈলশৃঙ্গে বিবুধাতিসঙ্গে তুলাদ্রিতুঙ্গেহপি মুদা বসন্তম্ ।
তমর্জুনং মল্লিকপূর্বমেকং নমামি সংসারসমুদ্রসেতুম্ ॥

অর্থাৎ- যিনি উচ্চ আদর্শভূত পর্বত থেকেও উচ্চ শ্রীশৈল পর্বতের শিখরে, যে স্থানে দেবতাদের সমাগম হয়, অত্যন্ত আনন্দ সহকারে নিবাস করেন এবং সংসার সাগর পার করবার জন্য যিনি সেতুস্বরূপ, সেই প্রভু মল্লিকার্জুনকে আমি নমস্কার জানাই।

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on print

মন্তব্য করুন