
কবে নিত্যানন্দ মোরে করি’ দয়া ।
ছাড়াইবে মোর বিষয়ের মায়া ॥
আর কবে নিতাইচাঁদ করুণা করিবে ।
সংসার-বাসনা মোর কবে তুচ্ছ হ’বে ॥
“কবে নিতাইচাঁদ করুণা করবে ? কবে আমার সংসার-বাসনা তুচ্ছ হয়ে যাবে ? নিত্যানন্দ প্রভু কবে আমাকে কৃপা করবে আমার যে সংসার-আসক্তি আছে, সে আসক্তিটা আমার কবে চলে যাবে ? কবে নিতাইচাঁদ করুণা করিবে আমাকে, আমি কবে এই সংসার থেকে উদ্ধার হতে পারব ?”
সংসার বলতে কি ? মায়ারূপ সংসার । সংসার থেকে উদ্ধার মানে আপনি স্ত্রী, পুত্র, ঘর ছেড়ে দিয়ে উদ্ধার পাবেন ? তা নয় । মায়ারূপ সংসার মানে মায়ার সংসারের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছেন, সমুদ্রের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছেন (“মায়ার বশে, যাচ্ছ ভেসে, খাচ্ছ হাবুডুবু ভাই”) । যিনি এই মায়ার সংসার থেকে উদ্ধার হয়ে যেতে চান, তাঁর নিত্যানন্দ প্রভুর কাছে কাঁদতে হবে । নিত্যানন্দ মানে গুরু-তত্ত্ব—গুরুদেবের কাছে কাঁদতে হবে । “কবে আমার এই সংসার বাসনা তুচ্ছ হবে ? আমি কবে গুরু-বৈষ্ণব-ভগবানের সেবা করতে পারব ? কবে আমি ভগবানের সেবায় নিজেকে নিযুক্ত করতে পারব ?” এইটাই সবসময় আমাদের চিন্তা করতে হবে, এইটাই আমাদের সবসময় ভাবতে হবে ।
ভগবানের অংশ বিশেষ জীবাত্মা আমাদের হৃদয়ের মধ্যে, সবাইয়ের মধ্যেই আছে কিন্তু আমরা একটু জং (মরিচা) পড়ে গেছি । একটা লোহা যদি বাইরে থাকে কয়েক মাস ধরে, সেই লোহাটার চুম্বক আকর্ষণ করবে না যেহেতু লোহাটায় জং পড়ে গেছে । জংটা তুললে তুললে তবে চুম্বক আকর্ষণ করতে পারবে । কৃষ্ণ আমাদের আকর্ষণ করবেন কিন্তু আমরা অনাদিকাল ধরে কৃষ্ণ-বহির্ম্মুখ হয়ে পড়েছি :
কৃষ্ণ ভুলি’ সেই জীব অনাদি-বহির্ম্মুখ ।
অতএব মায়া তারে দেয় সংসার-দুঃখ ॥
(শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃত, ২/২০/১১৭)
আমরা এই সংসারের ত্রিতাপ-জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরছি ! আপনি ভাবছেন যার টাকা আছে তার বুঝি খুব শান্তিতে আছে আর যার টাকা নাই তার খুব কষ্ট আছে । না । যারা লোভি হবে, তারা কষ্টও বেশি পাবে ; যারা জমি, টাকা পেয়েছে, তারা ত্রিতাপ-জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরছে—আধ্যাত্মিক যন্ত্রণায় (মানষিক যন্ত্রণায়) ছটফট করছে ।
সুতরাং নিজেই নিজের বন্ধু, নিজেই নিজের শত্রু । কে আপনার উপকার করতে পারেন যদি আপনি নিজেকে উপকার করতে না পারেন ? আপনি যদি ভগবানের দিকে এক পা এগিয়া যান, ভগবান আপনার দিকে দশপা এগিয়া আসবেন ।
যশোদা মা কৃষ্ণকে বাঁধতে গিয়েছেন, বারবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু বারবার দুই আঙ্গুল দড়ি short (কম) পড়েছিল । মা চেষ্টা করছেন, “আমার ছেলে আমি বাঁধ দেব !” আর ছেলেটা ভাবছেন, “মাকে একটা মজা দেখাই ! মা তো আমাকে ছেলেরূপেই ভাবে, আমাকে সবসময় বাৎসল্য রসে ভাবে, আর আমি তাকে একটু দেখাই !” গোপালকে বাঁধতে না পেরে বারবার যশোদা মা আরও দড়ি যোগ করলেন—যতগুলো গোরু আছে (তার বাড়িতে নয়লাখ গাভী ছিল !), তিনি সব দড়ি জোড়া দিলেন কিন্তু গোপালকে বাঁধতে পারছেন না—তিনি বাঁধছেন আর দেখেন দড়িটা কম ! কী লীলা, দেখুন ! বারবার দড়ি দুই আঙ্গুল কম হতে লাগল । মা রেগে গেছেন—সব দড়ি নিয়েও কিন্তু কাজ হচ্ছে না । শেষে গোপাল পূর্ব্ব দড়ি দিয়ে বন্ধন স্বিকার করলেন মনে ভেবে, “মা খুব কষ্ট পাচ্ছে, মায়ের ঘাম হচ্ছে… আমি তাকে কত কষ্ট দিছি, সেটা ভালো নয় । আমি তাকে আর কষ্ট দেব না ।” আর তখন গোপাল নিজেকে বেঁধে রেখে দিলেন ।
এই দুটো আঙ্গুল মানে কী ? একটা আঙ্গুল হচ্ছে ভক্তের চেষ্টা আর একটা আঙ্গুল হচ্ছে ভগবানের কৃপা । আপনার যদি চেষ্টা থাকে তাহলে ভগবান আপনাকে কৃপা করবেন—আপনি এক পা এগোলে, ভগবান দশ পা এগিয়ে আসবেন । সেইজন্য, যদি গুরু-বৈষ্ণব-ভগবানের সেবায় নিজেকে নিযুক্ত করতে পারি, তবেই তো আমাদের জীবনটা পরম ধন্য হয়ে যায় । কিন্তু বদ্ধ জীব এটা বুঝতে পারছে না…
দুর্লভ মানব জন্ম লভিয়া সংসারে ।
কৃষ্ণ না ভজিনু দুঃখ কহিব কাহারে ॥
সংসার সংসার করি মিছে গেল কাল ।
লাভ না হইল কিছু ঘটিল জঞ্জাল ॥
কিসের সংসার এই, ছায়াবাজী প্রায় ।
ইহাতে মমতা করি বৃথা দিন যায় ॥
দিন যায় মিছা কাজে নিশা নিদ্রাবশে ।
নাহি ভাবি মরণ নিকটে আছে বসে ॥
(কল্যাণকল্পতরু)
কখনও কে ভাবেই ?
শ্মশানে শরীর মম পড়িয়া রহিবে ।
বিহঙ্গ পতঙ্গ তায় বিহার করিবে ॥