
নিতাই ভট্টাচার্য্য :
ধর্ম তাহাই যাহা মানুষের কথা বলে, মনুষ্যত্বের কথা বলে, মানবতার কথা বলে, মহানুভবের কথা বলে, সহিষ্ণুতার কথা বলে। ধর্ম কখনই হিংসা বিদ্বেষের কথা বলে না, মারামারি, হানাহানি, কাটাকাটির কথা বলে না। সব ধর্মেই উদারতার কথা বলে, শান্তির কথা বলে। যেখানে শান্তির পায়রা উড়ে নাই সেখানে ধর্ম নাই। যাহারা সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দী অমুককে মারো, তমুককে কাটো বলিয়া গলা ফাটাইয়া ফতুয়া জাহির করিয়া বেড়ায়, খুব দুঃখের বিষয় তাহারা ধর্ম কি এখনো বোঝে নাই। ফাইভের ছাত্র যেমন পরীক্ষায় গণিত ছাড়া বাকিগুলো মুখস্ত লিখিয়া দিয়া আসে, ফতুয়া জাহির করা মানুষগুলোও ঐ রকম মুখস্ত বলিয়া যায়, আত্মস্ত করিতে পারে না। আজকের বিশ্বে যে ধর্ম নিয়া চরম বাড়াবাড়ি চলিতেছে তাহা ঐ ধর্মগ্রন্থ মুখস্ত মানুষগুলোর জন্যই। যতকাল না মুখস্ত ছাড়িয়া আত্মস্ত করিবে ততকাল এইভাবেই চলিতে থাকিবে। দারিদ্র্যের দুষ্টু চক্রের মত এখানেও মুখস্ত চক্র চলিতেছে, মুখস্ত শিক্ষক থেকে মুখস্ত ছাত্র, মুখস্ত পীর থেকে মুখস্ত অনুসারীগণ, মুখস্ত উস্তাদ থেকে মুখস্ত শিষ্য। এই মুখস্ত তুলিয়া দিবার জন্য সরকার প্রাণপণ চেষ্টা চালাইয়া যাইতেছে। তেমনই ধর্ম শিক্ষার ক্ষেত্রেও স্ট্রিম রুলার চালাইতে হইবে, তাহাতে যদি সফল হয় তবেই ধর্ম হাফ ছাড়িয়া বাঁচিবে, সাধারণ মানুষও হাফ ছাড়িয়া বাঁচিবে নইলে ঐ ধর্মপ-িতগণের স্ট্রিম রুলারে সাধারণ মানুষ মরিবে, ধর্মও মরিবে। সকল ধর্ম পন্ডিতগণের জানিয়ে রাখা উচিত যে, ধর্ম প্রতিষ্ঠা হইয়াছে মানুষের কল্যানের জন্য, ধর্মের কল্যাণের জন্য। তাই ধর্ম সর্বদা মানুষের কল্যান করিতে থাকিবে, মানুষের অকল্যাণ করিতে নয়, জীবন নিতে নয়। যাহারা ধর্মের নামে মানুষের জীবন নিতে উদগ্রীব তাহারা মুর্খ, গোড়া কিংবা মুখস্ত বিদ্যার অধিকারী। তাহাদের মাঝে বিনয় নাই, নম্রতা নাই, ভদ্রতা নেই, আছে শুধু উগ্রতা। আর এই উগ্রতায় আজকের বিশ্বে ধর্মীয় ডামাঢোলের মূল কারণ। আরেকটা কারণ নিজে কি করিলাম না ভাবিয়া অন্যেরা কি করিল তাহা নিয়া মাথা কুটিয়া মরা। নিজের প্রতিদিন কতবার ফরজ ছুটিয়া গিয়াছে তাহার হিসাব না করিয়া কাহার সুন্নত ছুটিয়া গেল তাহা নিয়ে ডামাডোলে সামিল না হইলে যেন নিজের ধর্ম থাকিবে না, তুমি ধর্মতত্ত্বের বাহিরের মানুষ হইয়া যাবা। মসজিদ কিম্বা মন্দিরে গিয়ে কপাল ঠুকিবার আগে নিজের অন্তরে একখানা মসজিদ কিম্বা মন্দির তৈয়ার করিতে পারিলেই কেবল তুমি ধার্মিক হইবে, সাথে মানুষও হইবে নইলে, তুমি ধার্মিক হইবে বটে, মানুষ হইবে না, তাই আজ ধার্মিকের অভাব না থাকিলেও মানুষের বড় অভাব আছে। এই অভাব যে সহজে পূর্ণ হইবার নয়। ইহা যে আজ বড় ধরনের শুন্যের কোটায় পড়িয়া রহিয়াছে। ধর্ম আসিয়াছে মানব মনে জড়তা, কঠোরতা, হীনতা, নীচুতা, শঠতা দূর করিয়া মহানুভাবতা, মানবতা, উদারতা, নম্রতা ও মনুষ্যত্ব জাগরণ করিয়া এক মহাশান্তির বিশ্ব গঠন করিবার জন্য যেখানে কোন প্রকার হিংসা বিদ্বেষের ছোয়া থাকিবে না, জাতিতে জাতিতে হানাহানি থাকিবে না, এক ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে দ্বন্দ্ব সংঘাত থাকিবে না। এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের মাঝে, এক জাতি থেকে অন্য জাতির মাঝে, এক গোষ্ঠী থেকে অন্য গোষ্ঠীর মাঝে সহজ ও সরলীকরণ চলাচলের জন্য একটি ব্রিজ থাকিবে সেই ব্রিজের নামই ধর্ম। এই ধর্ম সর্বদা মানব জাতির কল্যান করিতে থাকিবে। উঁচু-নিচু, জাত-অজাত-বিজাত, ধার্মিক-অধার্মিক নির্বিশেষে সমাজের সকল শ্রেণীর সম নীতি ও বন্টনের মাধ্যমে একটি সুষম, ন্যায় ভিত্তিক সমাজ গঠনে যে উঁচু মাপের ধর্মের প্রয়োজন তাহার নাম মানবতা।
আজকের এই মানসিক বিকারগ্রস্থ পৃথিবীর জন্য দায়ী এই মানবতার অভাব। এই মানবতার অভাবেই চলিতেছে মারামারি, কাটাকাটি, দেশ দখল, জায়গা দখল, ভারি অস্ত্রের মহড়া, পারমানবিক বোমা ছেড়ে আরো বহুগুণ শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা তৈরির মহোৎসব। এর একটি বোমায় একটি জাতি, একটি জনপদ সম্পূর্ণ ধ্বংস হইতে পারে আর মাত্র কয়েকটি বোমায় সারা পৃথিবী ধ্বংস হইতে পারে। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করিবার সবচেয়ে বড় অস্ত্র মানবতা। এই মানবতায় মানব জাতিকে রক্ষা করিতে পারে, পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারে, জাতিতে জাতিতে কিংবা ধর্মে ধর্মে সংঘাত থেকে রক্ষা করিতে পারে। আজকের পৃথিবীতে বাঁচিয়া থাকার মন্ত্র হইতে পারে এই মানবতা। যেখানে মানবতা নাই সেখানে মনুষ্যত্ব নাই, বিবেক নাই। মানবতার ঘাটতি দেখা দিলে চিন্তার উদ্রেক হইবে, কপালে ভাজ পড়িবে। একদিকে মানুষ যেমন টাকার পাহাড়ের উপর ঘুমাতে যায় অন্যদিকে ঠিক তেমনই প্রতিদিন প্রায় নব্বই কোটি মানুষ ক্ষুদার জ্বালা নিয়ে ঘুমোতে যায়। সারা বিশ্বে দশ ভাগ মানুষের যে সম্পদ বাকি নব্বই ভাগ মানুষের সম্পদ তার থেকে অনেক কম। এর অন্যতম প্রধান কারণ ঐ মানবতার অভাব। তাই আসুন আমি মুসলিম, আপনি হিন্দু, তিনি বৌদ্ধ, ওনি খ্রীস্টান সকল ধর্মের উপরে মানব ধর্মকে স্থান দিই, মানব জাতিকে রক্ষা করি।
মানবতার আলোকছটা ছড়াবার জন্য, মনুষ্যত্বের বাতি জ্বালাবার জন্য প্রথম আগাইয়া আসিতে হইবে তরুণদের। একমাত্র তারুণ্যের হাত ধরেই মানবতার বিজয়মাল্য পরিতে পারে। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান প্রত্যেকে তাহার নিজ নিজ ধর্মের গুণগানে ব্যস্ত। তাহারা নিজের ধর্মের গুণগান করিতেছে করিতে থাক, আমাদেরকে এই প্রত্যেক ধর্মের মাঝে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করিতে হইবে, একে অন্যের মাঝে ভালবাসার বীজ বপণ করিতে হইবে, সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করিতে হইবে, প্রত্যেকের মাঝে রজনীগন্ধার সুভাষ ছডাতে হইবে, সকালের মিষ্টি আলো মুঠি মুঠি ছডাতে হইবে মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডায়। সম্প্রীতির সুবাতাস বহিতে থাকবে পৃথিবীময়। আমাদের ভুলিয়া গেলে চলিবে না যে, যে যতবেশি ধর্মভীরু তার মধ্যে ততবেশি কঠোরতা। ঐ ধর্মভীরুকে শতভাগ সম্মান জানিয়ে, শ্রদ্ধা রেখে কঠোরতার বুকে আঘাত হানিতে হইবে যাহা সহজ কর্ম নহে। সকালে মসজিদ হইতে নামাজ পড়িয়া মন্দিরে পাহারা দিতে হইবে যাতে করে তাহারা নির্বিঘেœ পূজা-অর্চণা করিতে পারে কিম্বা পূজা-অর্চনা শেষ করিয়া মসজিদ বা প্যাগোডার সামনে সারি বেঁধে দাঁড়াইয়া থাকিতে হইবে। ধর্ম তাহার কর্ম করিয়া যাক, আমরা মনুষ্য সেবায় নিয়োজিত করিতে পারিলেই হইল। কেহ মসজিদ কিম্বা মন্দিরে যাইতে চাহিলে যেমন আমরা পৌছাইয়া দিব। আমাদের ধর্ম মানবতা, এই ধর্মকে সকল জাতির মাঝে বপন করিতে হইলে, মানুষের মাঝে নবরূপে এক আবহ তৈরি করিতে হইলে, মানবসত্ত্বাকে অন্ততপক্ষে মনুষ্যত্বের কাতারে আনিতে হইলে সর্বপ্রথম আমাকে আপনাকে আগাইয়া আসিতে হইবে, বিপদসংকুল এই মহাপথে মাথা আগাইয়া দিতে হইবে।
লেখক : নিতাই ভট্টাচার্য্য
প্রকাশক ও সম্পাদক, সনাতনী দর্পণ।