
হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, আষাঢ় মাসের শুক্লাপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে রথযাত্রা পালিত হয়। মোট ১১দিন ধরে জগন্নাথ-সুভদ্রা- বলরামকে উতসর্গ করে আরাধনা করা হয়। পুরীর রথযাত্রার ইতিহাস ও বর্ণনা-রীতি নিয়ে কপিলা সংহিতা, ব্রহ্ম পুরাণ, পদ্ম পুরাণ ও স্কন্দ পুরাণে উল্লেখ পাওয়া যায়। শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে, ‘রথস্থ বাম নং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে’ । অর্থাত্ রথের উপর অধিষ্ঠিত বামন জগন্নাথকে দর্শন করলে তাঁর পুনর্জন্ম হয় না। তাই রথের দড়ি টানাকেও পুণ্যের কাজ হিসাবে গণ্য করেন ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা। আগামী ১২ জুলাই রথযাত্রা। এদিন রথে চেপে মাসির বাড়ি যাত্রা করেন জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম। কিন্তু হঠাত্ মাসির বাড়িই কেন এত পছন্দ ? সেই মাসির নামই বা কি ? কোথায় তাঁর বাড়ি ? এই তথ্যগুলি অজানাই থেকে যায়। জগন্নাথদেবের প্রধান অনুষ্ঠানই হল রথযাত্রা । এই দিন দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রার সঙ্গে মাসির বাড়ি যান জগন্নাথ । মাসির বাড়ি অর্থাত্ ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুন্ডিচার বাড়ি । সেখান থেকে আবার সাতদিন পর মন্দিরে ফিরে আসেন জগন্নাথ । এটাকেই মাসির বাড়ি যাওয়া হলে । পরপর তিনটি সুসজ্জিত রথে চেপে মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে যান জগন্নাথ । এই যাওয়াকে সোজা রথ আর ফিরে আসাকে উল্টো রথ বলে । মনে করা হয়, পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রা থেকেই বাংলায় রথযাত্রার সূচনা । চৈতন্য মহাপ্রভু নীলাচল থেকে এই ধারাটি বাংলায় নিয়ে আসেন । চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর অনুকরণে রথযাত্রার প্রচলন করেন। এখন বাংলার বহু জায়গাতেই এই রথযাত্রা অত্যন্ত জনপ্রিয় । বাঙালিদের কাছে এখন রথযাত্রার দিনটি অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয় । অনেক শুভ অনুষ্ঠান হয় এই দিন । এমনকী খুঁটিপুজোর মাধ্যমে দুর্গাপুজোর সূচনাও হয় এই দিনেই ।
পৌরাণিক কাহিনি
পদ্মপুরাণে বর্ণিত আছে, মালবরাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন বিষ্ণুর পরম ভক্ত ছিলেন৷ তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটি মন্দির, নাম শ্রীক্ষেত্র (যা এখন জগন্নাথধাম হিসেবে পরিচিত)। কিন্তু মন্দিরে কোনো বিগ্রহ ছিল না। একদিন রাজসভায় কেউ একজন বললেন নীলমাধবের কথা। নীলমাধব নাকি বিষ্ণুর এক রূপ। তাঁকে কোথায় পাওয়া যাবে? জানা নেই কারো। তাই আয়োজন করে নীলমাধবকে খুঁজতে লোকজন পাঠালেন রাজা৷ কিন্তু নীলমাধব কি অত সহজে দেখা দেয়? কেউ তাকে খুঁজে পেল না৷ সকলেই যখন হতাশ হয়ে ফিলে এলো, তখন দেখা গেল না কেবল বিদ্যাপতিকে। জঙ্গলে পথ হারালেন তিনি। এরপর গল্পে প্রেমের ছোঁয়া লাগলো। হারিয়ে যাওয়া বিদ্যাপতিকে জঙ্গলে উদ্ধার করলেন শবররাজ বিশ্ববসুর কন্যা ললিতা। সেই সূত্রে তাদের মাঝে ভাব জমে ওঠে, ধীরে ধীরে তা প্রেমে পরিণত হয়। কিছুকাল প্রেম, এরপর বিয়ে করে জঙ্গলে দিব্যি সংসার করতে লাগলেন নবদম্পতি ললিতা আর বিদ্যাপতি। এদিকে বিদ্যাপতি লক্ষ্য করলেন, রোজই তার শ্বশুরমশাই স্নান সেরে কোথাও যান। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, জঙ্গলের গহীনে নীল পর্বতে নীলমাধবের মূর্তি রয়েছে। বিশ্ববসু সেখানেই রোজ নীলমাধবের পূজা দিতে যান। নীলমাধবের কথা জানতে পেরে খুশিতে আটখানা হলেন বিদ্যাপতি। তার হারিয়ে যাওয়া যেন সার্থক হলো! জানা মাত্রই বিশ্ববসুর কাছে অনুরোধ করলেন নীলমাধবের দর্শনের জন্য। প্রথমে নারাজ হলেও নাছোড়বান্দা জামাইয়ের অনুরোধ শেষতক মেনে নিতে হলো বিশ্ববসুকে। নীলমাধবের দর্শন পেয়ে তৎক্ষণাৎ ভক্তি ভরে পূজা করলেন বিদ্যাপতি।
নীলমাধব যখন স্বয়ং রাজা ইন্দ্রদুম্ন্যের পূজো নিতে চান, তখন কি আর দেরি করা যায়? চটজলদি খবর পাঠানো হলো রাজা ইন্দ্র্যদ্যুম্নের কাছে। রাজা বিস্ময়ে মহানন্দে সব ব্যবস্থা করে হাজির হলেন জঙ্গলের মাঝে নীলমাধবকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু জঙ্গলে পৌঁছনো মাত্রই আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না নীলমাধবের। তখন আবার দৈববাণী শোনা যায়,“সমুদ্রের জলে ভেসে আসবে যে কাঠ সেই কাষ্ঠখণ্ড থেকেই তৈরি হবে বিগ্রহ” (অর্থাৎ নীলমাধবের বিগ্রহ)। সবাইকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎই একদিন সমুদ্রের জলে কাঠ ভেসে এলো। মহাসমারোহে শুরু হলো বিগ্রহ তৈরির কাজ। কিন্তু কীভাবে তৈরি হবে? ভেসে আসা কাঠ এমনই শক্ত যে মূর্তি গড়া তো দূরে থাক, কেউ হাতুড়িই বসাতে পারল না কাঠে; উল্টো হাতুড়িরই যায় যায় অবস্থা! তাহলে মূর্তি গড়বে কে? মহারাজ আবারও পড়লেন বিপদে৷ ইন্দ্রদ্যুম্নের সেই অসহায় অবস্থা দেখে বুঝি এবার দুঃখ হলো ভগবানের। শিল্পীর রূপ ধরে স্বয়ং জগন্নাথ এসে দাঁড়ালেন রাজপ্রাসাদের দরজায়৷ বললেন, তিনিই গড়বেন ভগবানের বিগ্রহ। তবে তার একটি শর্ত আছে৷ শর্তটি এমন যে তিন সপ্তাহ বা ২১ দিনের পূর্বে কেউ তাঁর কাষ্ঠমূর্তি নির্মাণ দেখতে পারবে না। অতঃপর শর্তানুযায়ী কাজ আরম্ভ করলেন দারুশিল্পী। কিন্তু ইন্দ্রদ্যুম্নের রানী গুণ্ডিচার তর সইলো না। একদিন ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ না পেয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন এবং দেখলেন, কারিগর উধাও! সাথে তিনটি অর্ধসমাপ্ত মূর্তি দেখে তো রীতিমতো ভিরমি খেলেন তিনি! গোল গোল চোখ, গাত্র বর্ণসহ অসমাপ্ত মূর্তির না আছে হাত, না আছে পা। এ অবস্থা দেখে অনুশোচনায় আর দুঃখে বিহ্বল হয়ে পড়লেন রাজা-রানী দুজনেই৷ ভাবলেন, শর্ত খণ্ডনের ফলেই বুঝি এত বড় শাস্তি পেলেন তারা। তবে তাদের এই অনুশোচনা পর্ব দীর্ঘায়িত হতে দেননি ভগবান। স্বপ্নে উপস্থিত হয়ে জগন্নাথ জানিয়ে দিলেন, “এমনটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল৷ আমি এই রূপেই পূজিত হতে চাই”। এরপর থেকে এভাবেই ভক্তদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেন জগন্নাথদেব৷